তারাবী নামাজের তাত্পর্য ও ফজিলত

রমযান মাসেই সালাতুল তারাবী নামায আদায় করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী ২০ (বিশ) রাকাত নামাযের মাধ্যমে প্রথম সাতদিনে দেড় পারা এবং পরবর্তী বিশ দিনে একপারা করে সাতাশ দিনে পুরো ৩০ (ত্রিশ) পারা কোরআন শরীফ পাঠ করা হয়ে থাকে। এর উদ্দেশ্য, তাত্পর্য ও ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলার ঘোষনা হচ্ছে ” রমযান মাস হচ্ছে সে মাস যে মাসে নাযিল হয়েছে কোরআন। যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্য পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য বিধানকারী” সূরা বাক্কারা, আয়াত ১৮৫। উল্লে¬খিত আয়াতদ্বারা সুষ্পষ্টভাবে প্রমানিত হয় যে, ৩০ পারা কুরআনে মানবজাতির কল্যান নিহিত। কোরআনে সমগ্র মানবজাতির জীবন ব্যবস্থা কি হওয়া উচিত তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ননা করা হয়েছে। বর্ণনা করা হয়েছে কি কি গ্রহণীয়, কি কি বর্জনীয়। কি ন্যায় কি অন্যায়। কোন কোন কাজ করা হারাম এবং মানুষের জন্য কি কি হালাল। কোন কোন কাজের জন্য সে কি কি শাস্তি ভোগ করবে এবং আমল ভাল হলে সে কি কি পুরষ্কার পাবে। এ ছাড়া সকল কাজের হিসাব তিনি মহা বিচারক হিসেবে আখেরাতের দিবসে গ্রহণ করবেন। কাজেই সমগ্র বিষয়াবলীই যেন মানুষ জ্ঞাত হয়ে ভাল মন্দের পার্থক্য অনুধাবন করে জীবন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে সেজন্যই ৩০ পারা কোরআন পাঠের মাধ্যমে সালাতুল তারাবী নামায আদায় হয়ে থাকে। কাজেই মানুষ জাতিকে সচেতন করাই্ হচ্ছে তারাবী নামাযের প্রকৃত উদ্দেশ্য। এক রমযানের পর আরেক রমযানে এসে আবারও মানুষকে সচেতন করা হয়ে থাকে। সে কি কি ভুলে গিয়েছিল ঐগুলো যাতে সংশোধন করতে পারে। পরীক্ষার সময় প্রতিটি ছাত্র যেমন তার প্রশ্নের উত্তরগুলো রিভিশন দেয় তেমনি করে তারাবীর মাধ্যমে মানুষের মনে প্রতি বছর জাগ্রত করে দেয়া হয় আল্ল¬াহর বিধানাবলী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের কি করা উচিত আর আমরা কি করছি। আমাদের সকলেরই জানা যে, প্রতিদিন তিন ওয়াক্তের ফরজ নামাযে কোরআনের আয়াত (নামাযী এককভাবে হোক অথবা জামাতে ইমাম সাহেব) উচ্চস্বরে পাঠ করে থাকেন। যা সুষ্পষ্ট এবং আরবী আয়াতগুলোর প্রতিটি বাক্য সকলেই বুঝতে পারেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের কোন সুন্নত নামায, জামাতে এবং তার আয়াতগুলো উচ্চস্বরে পাঠ করা হয়না। অথচ তারাবীর এই সুন্নত নামায জামাতে এবং প্রতি রাকাতের আয়াতগুলো উচ্চ স্বরে পাঠ করা হয়ে থাকে। পার্থক্য হচ্ছে আমাদের দেশে ফরজ নামাযের আয়াত সুষ্পষ্টভাবে শোনা যায় কিন্তু তারাবী নামাযের আয়াতগুলো যিনি পড়েন এবং পেছনে যদি আরেকজন হাফেজ বা অভিজ্ঞ কোরআন পাঠক থাকেন তিনি ব্যতীত আর কেহই বুঝতে পারেন না হাফেজ সাহেব কি পড়ছেন। ফরজ নামাযের আয়াত যেভাবে পাঠ করা হয় তারাবী নামাযের আয়াত সেভাবেই পাঠ করা উচিত নয় কি ? তাই যদি না হয় তাহলে আল¬াহর ঘর বেষ্টিত মসজিদুল হারাম এবং বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (স.) এঁর রওজা বেষ্টিত মসজিদে নব্বীতে দু’ ঘন্টা সময় নিয়ে তারাবীর নামায আদায় হয় কেন? আমরা যারা রমযান মাসে ওখানে যাচ্ছি তারা সকলেই এ দীর্ঘ সময় ধরে ইমামের পেছনে নামায আদায় করেছি তা কারো অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রথম প্রথম যারা গিয়েছি তাদের সবার মধ্যেই ভীতি ও শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছিল এতো দীর্ঘ সময় ধরে নামায পড়তে পারবো কিনা? কিন্তু সালাতুল তারাবী যখন শুরু হলো তখন প্রথম রাকাতের আয়াত পাঠ শেষে ইমাম যখন রূকুতে যাচ্ছে তখন ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হলো যেন তাড়াতাড়ী রূকুতে গেলেন, আরও কিছু আয়াত পড়লো না কেন? এমনিভাবে ২০ রাকাত যখন শেষ হলো তখন মনে হয়নি যে ২ ঘন্টা ধরে নামায পড়েছি। এতে করে আমাদের কারো কোন কষ্ট বা পায়ে ব্যথা অনুভব হয়নি। দীর্ঘ সময় নামায পড়ায় কষ্ট না অনুভূত হওয়ার কারণ হচ্ছে ইমাম সাহেবদের সুরেলা কণ্ঠে উচ্চারিত কোরআনের প্রতিটি শব্দ/আয়াত যা ছিল পরিষ্কার এবং প্রতিটি মুসলমান নর নারীর বোঝার উপযোগী। তাঁদের কণ্ঠ যেমন আমাদের আকৃষ্ট করেছে তেমনি যেখানে যেখানে ভয়ের / আযাবের আয়াত পাঠ করেছে সেখানে তাদের কণ্ঠের ক্রন্দনভাব আমাদের আবেগে আপ্লুত করেছে। অনুরূপভাবে যেখানে ছিল রহমতের / আল্ল¬াহর পথে চলার আহ্বান সেখানে তাদের কণ্ঠের অনুরূপ ভঙ্গি আমাদের আন্দোলিত করেছে। আরবী ভাষাভাষীর মানুষ না হয়েও মনে হয়েছে যেন আমরা বুঝতে পারছি তিনি আল্ল¬াহর কি বানী পড়ছেন। তাঁদের কণ্ঠের মাধুর্যতা, উচ্চারনের তাল ও লয় যেন এক অপরূপ মহিমায় সমগ্র নামাযীকে আকৃষ্ট ও ধন্য করেছে। ঐ তেলাওয়াত যেমন ছিল হূদয়স্পর্শী তেমনি যখন তাদের কণ্ঠে আবেগপ্রবন আয়াত উচ্চারিত হয়েছিল তখন অন্তর হয়েছিল ভীত সন্ত্রস্ত্র, আবার কখন কখন হয়েছিল হেদায়েতের পথে চলার শক্তি পাবার প্রেরণা। সর্বোপরি অধিকাংশ আয়াতের অর্থ বুঝিনি সত্য তবে কোরআন তাঁদের কণ্ঠে শুনে কোরআন পড়েছি বলা যায়। আল্লাহর ঘর বেষ্টিত মসজিদুল হারাম এবং বিশ্ব নবীর রওজা বেষ্টিত মসজিদে নববীকে আমরা সকলেই মুসলিম বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে জানি এবং মানি। তাই যদি হয় তাহলে ঐ প্রাণকেন্দ্রদ্বয়ে যদি তারাবীর নামায দু’ ঘন্টা পনের মিনিট ব্যাপী পড়া হয় এবং তাদের ইমামের পড়া কুরআনের প্রতিটি আয়াত যখন নামাযরত প্রতিটি মুসলিম নর নারীর বোধগম্য হয় তাহলে আমাদের দেশের নামাযে এত অষ্পষ্টতা কেন এবং কেনই বা কোরআন পড়ায় এত তাড়াহুড়া। এ নামায যদি তাড়াহুড়ার নামায হতো তাহলে ওখানে কেন আমাদের দেশের মত পড়া হয়না।

সেহরি ও ইফতারের গুরুত্ব

পবিত্র মাহে রমজানের প্রতিটি দিনের সূচনা হয় সেহরির মাধ্যমে। আর সমাপ্তি হয় ইফতারের মাধ্যমে। এজন্য রমজানের রোজা ও তারাবির পাশাপাশি আরও যে উপলক্ষ ও ইবাদত ব্যাপকভাবে সমাজকে স্পর্শ করে তা সেহরি ও ইফতার। রোজার প্রস্তুতি ঘোষণা করতে হয় সেহরির মাধ্যমে এবং সমাপ্তি ঘোষণা করতে হয় ইফতারের মাধ্যমে। কুরআন-হাদিসের আলোকে সেহরি ও ইফতার সম্পর্কে বিশদ আলোচনা এখানে সন্নিবেশিত করা হলো-

রোজা রাখার উদ্দেশ্য মুসলমানরা সুবহে সাদিকে আগে সেহরি খেয়ে থাকেন। রোজা পালনের জন্য সেহরি খাওয়া সুন্নাত ও অধিক পুণ্যের কাজ। ক্ষুধা না থাকলেও সামান্য একটু পানি পান করাকেও সেহরি হিসেবে গণ্য করা হয়।

সেহরি খাওয়ার মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহর অনুসরণ করা হয়। অন্যদিকে সেহরি খাওয়ার মাধ্যমে রোজা রাখার শক্তি অর্জিত হয়। সেহরি খেলে রোজাদার সহজে দুর্বল ও মনোবলহীন হয়ে পড়েন না, সারাদিন দীর্ঘ সময়ের উপবাস বা অনাহারে থাকলেও কর্মঠ থাকার প্রাণশক্তি আসে এবং সিয়াম পালন সহ্যসীমার মধ্যে থাকে।

যতক্ষণ পর্যন্ত সুবহে সাদিক না হয় অর্থাৎ পূর্ব দিগন্তে সাদা বর্ণ না দেখা যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত সেহরি খাওয়ার অনুমতি আছে। সুবহে সাদিক হয়ে গেলে তারপর আর কিছু খাওয়াদাওয়ার সুযোগ নেই। সেহরি খাওয়ার সময়সীমা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা পানাহার করো, যতণ না কালো রেখা থেকে ভোরের সাদা রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রাত পর্যন্ত রোজা পূর্ণ করো।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৭)

রাসুল (সা.) সেহরি খেতে আদেশ করেছেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সেহরি খাও, কারণ সেহরি তে বরকত রয়েছে।’ রাসুল (সা.) কখনো সেহরি থেকে বিরত থাকতেন না। সাহাবায়ে কেরামকেও সেহরির ব্যাপারে তাগিদ দিতেন এবং নিজের সঙ্গে শরিক করতেন।

রাসুল (সা.) এর কাছে একজন সাহাবী এলেন যখন তিনি সেহরি খাচ্ছিলেন। রাসুল (সা.) তাকে দেখে বললেন, এ খাবার বরকতের। আল্লাহ পাক বিশেষভাবে তোমাদের তা দান করেছেন। কাজেই তোমরা সেহরি খাওয়া ছেড়ে দিও না। (নাসাঈ)

মুসলিম শরীফে হযরত আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, আমাদের এ সিয়াম ও আহলে কিতাবদের (ইহুদী ও খৃষ্টান) রোজার মধ্যে পার্থক্য হল সেহরি খাওয়া।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যেসব মুসলমান ভোরের এ সময়ে জেগে আল্লাহ পাকের হুকুম মেনে সেহরি খেতে বসে, আল্লাহ পাক খুশি হয়ে তাদের জন্য বিশেষ রহমত অবতীর্ণ করেন এবং মহান আল্লাহর ফেরেশতারা সেহরি গ্রহণকারীদের জন্য বিশেষ দোয়া করতে থাকেন। (মুসনাদে আহমদ)

সেহরি খাওয়ার উত্তম সময়ও নির্দিষ্ট করা আছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা রাতের অন্ধকার প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত পানাহার কর।’ (বাকারা-১৮৭)

দেশ ও অঞ্চলভেদে সেহরিতে খাবারের ধরন ভিন্ন হয়ে থাকে। তবুও রাসুল (সা.) সেহরির সময় খেজুরকে সর্বোত্তম খাদ্যদ্রব্য বলেছেন। আবু দাঊদ শরীফে এক বর্ণনায়- খেজুরকে সর্বোত্তম সেহরি বলেছেন রাসুল (সা.)। এজন্য সেহরির সময় দু-একটি খেজুর খেলে এ সুন্নত আদায় হবে। এ ছাড়া আধুনিককালের স্বাস্থ্যবিজ্ঞান মতে, খেজুরের ভেতর যে শক্তি ও পুষ্টিগুণ রয়েছে তা রোজাদারের জন্য অনেক বেশি শক্তিদায়ক এবং বিশেষ উপকারী।

অনেকে তারাবির পর খানা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন, অলসতা করে সেহরি খাওয়ার জন্য পুনরায় জাগ্রত হওয়াকে বোঝা মনে করেন তাদের জেনে রাখা দরকার যে, এটা সুন্নতের পরিপন্থী কাজ। এতে সেহরির ফজিলত ও বরকত থেকে বঞ্চিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। সেহরির সময় একটু আগেভাগে উঠে আট রাকাত তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করা বড় সৌভাগ্যের বিষয়। সেহরি খাওয়ার পর রোজার নিয়ত অন্তরে করাই যথেষ্ট, মুখেও যদি বলে তাহলে ভালো ‘আমি আগামীকাল রমজান মাসের রোজা রাখার নিয়ত করলাম’। (জাওয়াহিরুল ফিকহ)

কারওয়ান বাজার ঢাকার আম্বারশাহ শাহী মসজিদের প্রধান ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা আতাউল্লাহ সেহরি খাওয়া সম্পর্কে এক নিবন্ধে লেখেন- রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা সেহরি খাওয়াবান্দার ওপর রহমত নাজিল করেন।’ সেহরি খাওয়া যেহেতু সুন্নত, তাই সুন্নতের ওপর আমল করার জন্য ক্ষ‍ুধা না হলেও পানি বা অন্য কিছু খেয়ে নেয়া উচিত। কারণ হাদিস শরিফে এসেছে ‘তোমরা সেহরি খাও, কেননা সেহরিতে বরকত রয়েছে।’ সেহরি দেরিতে খাওয়া মুস্তাহাব। তবে এত বিলম্ব না করা উচিত, যার কারণে রোজার মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়ে পড়ে।

তিনি লেখেন- হজরত ইয়ালা বিন মুররাহ রাজি থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহতায়ালার কাছে তিনটি বস্তু অধিক পছন্দনীয়। এক. সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাড়াতাড়ি ইফতার করা। দুই. সেহরি দেরিতে খাওয়া। তিন. নামাজে হাত বেঁধে আল্লাহর ধ্যান-খেয়ালে আদবের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা।’

সেহরির মধ্যে বিলম্ব করা মুস্তাহাব। সেহরি খাওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব করার অর্থ হল, ততক্ষণ পর্যন্ত পানাহার করা বৈধ যতক্ষণ শুভ্র রেখা উদিত না হয়। যখন শুভ্র রেখা উদিত হয়ে যায় তখন পানাহার বর্জন করা চাই।

বর্তমানে আমাদের দেশের আবহাওয়া দফতর থেকে সেহরি ও ইফতারের সঠিক সময় আগেই ঘোষণা করা হয়ে থাকে এবং মসজিদের মুয়াজ্জিনরাও সেই সময়সূচি অনুসরণ করে আজান দিয়ে থাকেন। ওলামায়ে কেরামের পরামর্শ অনুযায়ী সতর্কতা হিসেবে প্রয়োজনের সামান্য আগপাছ করা হয়।

রোজা পালনে ইফতারের গুরুত্বও অপরিসীম। আবার সময়মতো ইফতার করার মধ্যেও রয়েছে অশেষ সওয়াব ও কল্যাণ। রাসুলে কারিম (স.) এরশাদ করেন, তোমরা ইফতারের সময় হওয়ামাত্র ইফতার করে নাও। এতটুকু বিলম্ব করো না।

এ সম্পর্কে তিরমিজি শরীফে উল্লেখ আছে যে, আমি ওই ব্যক্তিকে সর্বাধিক ভালোবাসি যে ইফতারের সময় হওয়ামাত্র ইফতার করে নেয়। আবু দাউদ শরীফে আছে, হযরত রাসূলে পাক (স.) যখন ইফতার করতেন, তখন বলতেন, আমার তৃষ্ণা নিবৃত্ত, আমার শিরা উপশিরা সিক্ত হয়েছে এবং আল্লাহপাক পরওয়ারদেগারের পুরস্কার নির্ধারিত হয়ে গেছে।

হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘মানুষ ততদিন কল্যাণের মধ্যে থাকবে যতদিন তারা ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করে নেবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

ইফতারের সময় এ দোয়া পড়তে হয়, ‘আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়া আলা রিজকিকা আফতারতু অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! তোমার জন্যই রোজা পালন করলাম, আর তোমার প্রদত্ত রিজিক দিয়েই ইফতার করছি।’

রাসুলুল্লাহ (সা.) কয়েকটি তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তাজা খেজুর না পেলে শুকনো খেজুর, অর্থাৎ খোরমা দিয়ে ইফতার করতেন। আর যদি তাও না পেতেন, তাহলে কয়েক ঢোক পানি পান করে নিতেন। এ ছাড়া ইফতারের আগ মুহূর্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। দোয়া কবুল হওয়ার অন্যতম সময়। হুজুর (সা.) বলেছেন, ‘ইফতার করার সময় রোজাদারের দোয়া কবুল হয়ে থাকে।’ (আবু দাউদ)

বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছিলেন, ‘দাস-দাসীদের প্রতি সর্বদা সদ্ব্যবহার করবে। তাদের ওপর কোনোরকম অত্যাচার করবে না। তোমরা যা খাবে তাদেরও তাই খাওয়াবে; যা পরবে তাই পরাবে। ভুলে যেও না তারও তোমাদেরই মতো মানুষ।’ অতএব আমরা যখন ঘরে ইফতার করি তখন যেন বাসার গৃহকর্মী ও অধীনস্থদের নিয়ে পরিবারের সবাই একসঙ্গে ইফতার করি। কোনো রোজাদারকে ইফতার করানো অত্যধিক ফজিলতের কারণ।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আব্দুস সালাম আল-মাদানী ইফতার সম্পর্কিত এক নিবন্ধে লেখেন- রমযানের সুন্নত আমল সমূহের মধ্যে অন্যতম হলো ইফতার। হযরত সালমান ফারসী (রা.) বর্ণিত হাদীসে এসেছে, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘রোযাদারের জন্য দুটি আনন্দ। একটি আনন্দ ইফতারের সময়, অপর আনন্দ তার রবের সাথে সাাত।’

তিনি লেখেন- হাদিসে কুদসিতে আছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় ঐ বান্দাগণ যারা বিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি ইফতার করে।’ হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সে পর্যন্ত দ্বীন ইসলাম বিজয়ী থাকবে যতদিন মানুষ শিঘ্র ইফতার করবে। কেননা ইহুদি ও নাসারাগণ দেরিতে ইফতার করে।’

সময়মত ইফতার করা যেমন ফজিলতের তেমনি রোযাদারকে ইফতার করানোর ফজিলতও অনেক। হযরত সালমান ফারসী (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করাবে তার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে। ঐ রোযাদারের সওয়াবের সমপরিমাণ সওয়াব সে লাভ করবে, তবে ঐ রোযাদারের সওয়াবে কোন কম করা হবে না। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমরা সবাই রোযাদারকে ইফতার করাতে সম নই। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, পানি মিশ্রিত এক চুমুক দুধ বা একটি শুকনো খেজুর অথবা এক ঢোক পানি দ্বারাও যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করাবে আল্লাহ তাকে এ পরিমাণ সওয়াব দান করবেন। আর যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে পরিতৃপ্তভাবে খানা খাওয়াবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে আমার হাউজ (হাউজে কাওসার) হতে এমন পানীয় পান করাবেন, যার ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করার পূর্বে তৃষ্ণার্ত হবে না।’ (বায়হাকী ওয়াবুল ঈমান, মেশকাত)

রমযানের প্রস্তুতি

১. সিয়ামের বিধি-বিধান সম্পর্কে প্রয়োযজনী জ্ঞান অর্জন করা:
এজন্য ইরশাদ হয়েছে: তোমরা যদি না জানো, তাহলে যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর” (আন-নাহল:৪৩)।
মূলত যারা ধর্মীয় জ্ঞানে গভীরতা অর্জন করে, তারাই প্রকৃত ভাগ্যবান, তারাই শ্রেষ্ঠ। রাসূল (স.) বলেন, আল্লাহ যার কল্যাণ সাধন করতে চান, তাকে ধর্মের গভীর জ্ঞান দান করেন” (বুখারী-মুসলিম)।

২. বিশেষ বিশেষ কাজের অভ্যাস গড়ে তোলা:
ক. শাবানের সিয়াম: এ কারণেই রাসূল শাবানের রোযা রাখতেন। ফলে রমাদানের রোজা আসার আগেই দেহ-মন রোজায় অভ্যস্ত হয়ে যেত।
খ. রাত্রি জেগে নামায পড়া: রমাদানে দুটি কিয়ামুল লাইল আছে। একটি তারাবীহ। অন্যটি তাহাজ্জুদ। রামাদান যেহেতু জীবনের মহাসুযোগ। তাই রমাদানের আগে থেকেই রাতজেগে নামায পড়ার কিছু কিছু অভ্যাস গড়তে পারলে রহমতের মৌসুমে তা সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
গ. কুরআন তিলাওয়াতের অভ্যাস:
রমাদান কুরআনের মাস। কুরআনের কারণেই রমাদানের মহা-সম্মান। ইবনে রজব আল-হাম্বলী বলেন,
“শাবান যেহেতু, রমাদানের ভূমিকা স্বরূপ, তাই রমাদানে যা কিছু শরীয়তসিদ্ধ, শাবানেও তা-ই শরীয়তসিদ্ধ । যেমন, সিয়াম, কুরআন তিলাওয়াত। যাতে রমাদানকে গ্রহণ করে নেয়ার প্রস্তুতি অর্জিত হয়। আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি নাফস বশীভূত হয়। সালামাহ বিন কুহাইল “শাবানকে বলা হতো, কারীদের (কুরআন তিলাওয়াত ও চর্চাকারীদের) মাস”।
ঘ. বদ-অভ্যাসসমূহ পরিত্যাগ করা এবং সদাভ্যাস ধারণ করা:
মানুষ অভ্যাসের দাস নয়; বরং অভ্যাসই মানুষের দাস। এ কথা সিয়াম সাধনার দ্বারা প্রমাণিত হয়। তবে সে জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয় আগেভাগেই। তাই সিয়াম সড়কে আমাদের যাত্রা শুরু হোক সকল বদাভ্যাস মুক্ত হয়ে সদাভ্যাসের শুভ্র পোশাকে অলংকৃত হয়ে।

৩. মুহাসাবতুন নাফস বা আত্ম পর্যালোচনা:
জবাবদিহিতা শুন্য, বলগাহীন, যথেচ্ছ জীবন যাপন করা মুমিনের পরিচয় নয়। আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে জবাবদিহিতা করার পূর্বেই মুমিন নিজের কাঠগড়ায় দাঁড়ায়। নিজের কাছে নিজেই জবাবদিহি করে। আল্লাহ বলেন:
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; আর প্রত্যেকের উচিত চিন্তা করে দেখা সে আগামীকালের জন্য কি প্রেরণ করেছে; তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত”                      (সূরা আল-হাশর : ১৮) ।
এ জন্য রমাদান আসার আগেই প্রত্যেক মুমিনের উচিত আত্মসমালোচনা করা।

৪. সওয়াবের মওকা:
রমযান মাসে মুমিনের ইবাদতের সাওয়াব বৃদ্ধি করা হয় বহু গুণে। হাদিসের ভাষায়ঃ ‘আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব দশগুণ হতে সত্তরগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়’। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কেউ যদি ‘আলহামদুলিল্লাহ’ এই নয়টি হরফের শব্দটি একবার উচ্চারণ করে ১০ নেকী হিসাবে ৯০ নেকী পাবে। ওযুসহ পড়লে ২১৫ নেকী, বসা নামাযে পড়লে ৪৫০ নেকী, নামাযে দাঁড়িয়ে পড়লে ৯০০ নেকী আর রমযানে পড়লে ৭০ গুণ হিসাবে ৬৩০০০ নেকী পাওয়া যাবে। তাই এ মাসে বেশি করে নেক আমল করা দরকার।

৫. খাবার অভ্যাস স্বাভাবিক ভাবেই রমযানে পরিবর্তন করতে হয়। সন্ধ্যায় মাগরিবের পর ভারসাম্যপূর্ণ খাবার খান। কোন ভাবেই অতিরিক্ত খাওয়া ঠিক হবেনা। সন্ধ্যায় চা, কপি, সোডা জাতীয় খাবার পরিহার করুন। তরল ও পানি বেশি খান। ফল খাওয়া যেতে পারে। ভাজা পোড়া ও মসলা জাতীয় খাবার কম গ্রহন করুন। প্রচুর পরিমানে মিসওয়াক করুন।

আসুন রমযানের কদর করি :
মাহে রমযানের এত বেশি গুরুত্ব মূলত পবিত্র কুরআনের কারণে। এ মাস কুরআন নাযিলের মাস। তাই এ মাসে কুরআন অধ্যয়ন করতে হবে, কুরআন নাযিলের প্রকৃত উদ্দেশ্য অনুধাবন করে সে অনুযায়ী আত্মগঠন করতে হবে। মনকে ইবাদতের মাঝে নিবিষ্ট করার জন্য অর্থ বুঝে নামাযে কুরআন পড়তে হবে। রমযানে কুরআন তিলাওয়াতের গুরুত্ব সমধিক। হাদিসে এসেছেঃ ‘রোযা ও কুরআন রোযাদার ব্যক্তির জন্য শাফাআত করবে। রোযা বলবে হে আল্লাহ! আমি অমুক ব্যক্তিকে দিনের বেলা পানাহার ও কামনা-বাসনা থেকে ফিরিয়ে রেখেছি, তার পক্ষে আপনি আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। আল্লাহ সুপারিশ গ্রহণ করবেন। এভাবে কুরআন সুপারিশ করবে এই বলে যে, হে আল্লাহ! আমি এ ব্যক্তিকে রাত্রের নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন, আল্লাহ তার সুপারিশ গ্রহণ করবেন।(বায়হাকী)। ব‘ত মানব ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কুরআন নাযিলের ঘটনা। কুরআনের আলোকেই মানব জীবনকে সাজাতে হবে, ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কুরআন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সূর্যবিহীন সৌরজগৎ যেমন নিষ্প্রভ ও তিমিরাচ্ছন্ন তেমনি কুরআনবিহীন মানব সমাজ নিরর্থক ও অকল্পনীয়। মাহে রমযান থেকে এ শিক্ষা নেয়া জরুরি।

রাসুল (সঃ) বলেছেনঃ ‘রোযা রেখে যে মিথ্যা পরিত্যাগ করতে পারল না তার পানাহার ত্যাগ করার আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই (বুখারী, মুসলিম)। অন্য হাদিসে আছে ‘কিছুসংখ্যক রোযাদার রোযার ক্ষুৎ পিপাসায় কষ্টভোগ ছাড়া আর কিছুই লাভ করে না। আবার কিছুসংখ্যক রাতজাগা লোকের রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছুই লাভ করে না’। তাকওয়া এমন একটি মহৎ গুণ যার মাধ্যমে রিযিকের ফায়সালা হয় এবং বরকতের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ বলেনঃ ‘যদি লোকালয়ের লোকেরা ঈমান আনে তাকওয়া অবলম্বন করে, তবে আমি তাদের জন্য আকাশ ও জমিনের বরকতসমূহের দরজা খুবে দেব (সুরা আরাফঃ ৯৬)।

তাই আমাদের সামর্থের সকল প্রচেষ্টা দিয়ে রমযানের ইবাদতে ব্রতী হওয়া জরুরি। ঈমানী চেতনাকে শানিত করতে রমযান মহাসুযোগও বটে। আসুন আমাদের ইমানকে উজ্জিবীত ও তাজা করি।

রমযানের গুরুত্ব :

রোযা ফরজ ও ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের একটি। প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম নর-নারী যাদের কোন শরীরি ওযর নেই তাদের উপর রমযানের রোযা পালন করা ফরয। কেউ যদি বিনা ওযরে রোযা না রাখে সে এমন গুনাহ করলো যে, সারাজীবন রোযা রেখেও তার ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারবে না। রাসুল (সঃ) বলেছেনঃ ‘কেউ যদি ওযর ছাড়া রমযানের একটি রোযা না রাখে তবে সারাজীবন রোযা রাখলেও এর ক্ষতিপূরণ হবে না’। (মিশকাতুল মাসাবীহ) হাদিস শরিফে এসেছে- ‘যখন রমযান মাস শুরু হয় তখন আকাশের রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানগুলোকে শিকলে আবদ্ধ করে দেয়া হয়’। (বুখারী)

১. কুরআনের মাস :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াত স্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নির্দেশাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে” (বাকারাহ:১৮৫)।
আল্লামা ইবনে কাসীর বলেন,
“আল্লাহ অন্যান্য মাসের মধ্যে সিয়াম মাসের বিশেষ মর্যাদা তুলে ধরছেন। কারণ এ মাসকেই তিনি কুরআন নাযিল করার জন্য পছন্দ করেছেন”।
অতএব বেশী বেশী কোরআন তেলাওয়াত করতে হবে। যারা যানেনা শিখতে হবে। যাদের শুদ্ধ হয়না তারা শুদ্ধ তেলাওয়াত শিখতে হবে।
২. রমাযান জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির মাস :
হযরত জাবির বিন সামুরা (রা.) রাসূল (স.) থেকে বর্ণনা করেন, “আমার কাছে একদা জিব্রাইল আগমন করলেন। বললেন, হে মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তি তার মাতা-পিতা কাউকে জীবিত পেল তারপর মৃত্যু বরণ করল এবং জাহান্নামে গেল, আল্লাহ তাকে (তাঁর রহমত থেকে) বিতাড়িত করুন। আপনি বলুন, আমীন। আমি বললাম, আমীন। তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তি রমাদান মাস পেল তারপর মৃত্যু বরণ করল এবং জাহান্নামে গেল, আল্লাহ তাকে (তাঁর রহমত থেকে) বিতাড়িত করুন। আপনি বলুন, আমীন। আমি বললাম, আমীন। তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তির সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হলো, কিন্তু আপনার উপর দরুদ পড়ল না, অতঃপর মৃত্যু বারণ করল এবং জাহান্নামে গেল, আল্লাহ তাকে (তাঁর রহমত থেকে) বিতাড়িত করুন। আপনি বলুন, আমীন। আমি বললাম, আমীন”।
রাসূল (স.) ইরশাদ করেন:
“রমাযানের প্রতিটি দিন-রাতে আল্লাহ অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। তাদের প্রত্যেকের দু‘আ আল্লাহ কবুল করেন”।

৩. সমাজ জীবনে সবার সাথে সদ্ভাব প্রতিষ্ঠা করা:
শাবান রমাযানের প্রস্তুতির মাস। এ মাসের একটি অন্যতম পবিত্র রজনী হচ্ছে ১৫তম রজনী। এ রাত সম্পর্ক হাদীসে রয়েছে,
“এ রাতে আল্লাহ তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি তাকান। অতঃপর মুশরিক ও মুশাহিন (বিদ্বেষপোষণ কারী) ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন”। হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে রমাযানকে বরণ করা এ হাদীসের একটি অন্যতম দাবী। কারণ, মুশরিক শিরক করে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, আর মুশাহিন বিদ্বেষের মাধ্যমে মানুষের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ক্রমান্বয়ে ধর্ম থেকে বিচ্যুত হতে থাকে। এবং এক পর্যায়ে আল্লাহ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায। তাই রমাযান থেকে কোন প্রকার সুফল লাভ করতে পারেনা।
তাই রমাযানকে বরণ করে নেয়ার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে, মানবীয় পর্যায়ের সকল সম্পর্ককে সুসংহত ও উন্নত করা। যেমন, মানুষকে মাফ করে দেয়া, মানুষের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা, আত্মীয-স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, মনকে হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা-পরশ্রীকাতরতা থেকে পবিত্র করা। এতে মন পবিত্র হয়। পবিত্র মন আসমানী শিক্ষা দ্বারা উপকৃত হয়। আল্লাহর রহমান ও মাগফিরাতের যোগ্য হয়।

৪. রমযান লাইলাতুল কদরের মাস।

রমযান মাসের গুরুত্ব সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদীসটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। হযরত সালমান ফারসী ( রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূল ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) শাবান মাসের শেষ দিন আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের নিকট এক মহান ও বরকতময় মাস সমাগত। সে মাসে একটি রাত আছে, যা এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তাআলা এ মাসের তোমাদের উপর ফরজ করে দিয়েছেন এবং ( তারাবীহ ইত্যাদির জন্য ) রাত জাগরণ করা সওয়াবের বিষয় করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি এ মাসে একটি নফল আদায় করবে, সে অন্য মাসের একটি ফরজ আদায়ের ফজীলত লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি এ মাসে ফরজ আদায় করবে, সে অন্য মাসে সত্তরটি ফরয আদায়ের সমান সওযাবের অধিকারী হবে।..

৬. জীবনের সীমানা নির্ধারনি মাস হচ্ছে রমযান।

হযরত আবুবকর রা. এর সময় প্রধান বিচারক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন হযরত উমর রা.। এক বছর পার হওয়ার পর তিনি খলীফাতুর মুসলিমিন হযরত আবু বকর রা. এর নিকট গিয়ে বললেন আমীরুল মু’মিনীন আমার তো কোন কাজ নেই। কেউ বিচার নিয়ে আমার কাছে আসেনা। খলীফা জিজ্ঞেস করলেন কেন? লোকজন কি আপনাকে ভয় পায়?। হযরত উমর রা. জবাব দিলেন আমার মনে হয় তা নয়। আমার বিশ্বাস এ অর্ধ দুনিয়ার প্রতিটি মানুষ তাদেও জীবনের সীমানা চেনে। যখনি তারা সীমানায় চলে আসে থেমে যায়। সীমা লঙ্গন করেনা। সেজন্য অপরাধ হয়না। মানুষও আমার কাছে আসেনা।

রোযার উদ্দেশ্য :

১. রোযা ধৈয্য ও সংযম শেখায়। আত্ম নিয়ন্ত্রন শক্তির উন্নয়ন ঘটায়। রসুল স. বলেছেনঃ ‘রমযান হল সবরের মাস, আর সবরের পুরস্কার হল জান্নাত’। রোযা আমাদের পরিবেশ দিয়ে সাহায্য করে যাতে করে আমরা অসৎ ইচ্ছা, খারাপ অভ্যাস প্রতিরোধ করতে পারি এবং শযতানের মোকাবেলায় ঢাল অর্জন করি। এতে নৈতিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। এজন্যই রোযাকে ঢাল স্বরূপ।

২. আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সহায়ক। রোযা ইবাদতের সুযোগ ও তাকওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে। হযরত সালমান (রাযিঃ) বলেন, নবী করীম (সঃ) শাবান মাসের শেষ তারিখে আমাদিগকে নসীহত করেছেন যে তোমাদের উপর এমন একটি মাস আসছে, যা অত্যন্ত মর্যাদাশীল ও বরকতময়। এই মাসে এমন একটি রাত্র রয়েছে,যা হাজার মাস থেকে উত্তম। আল্লাহ তায়ালা এই মাসে রোযা রাখাকে ফরয করেছেন এবং এই মাসের রাত্রিগুলোতে (তারাবীহ) পড়াকে ছওয়াবের কাজ করেছেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য এই মাসে কোন নফল ইবাদত করল, সে যেন রমযানের বাইরে একটি ফরজ আদায় করল। আর যে ব্যক্তি এই মাসে কোন ফরজ আদায় করল সে যেন রমযানের বাইরে সত্তরটি ফরয আদায় করল। এটা ছবরের মাস আর ছবরের বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা জান্নাত রেখেছেন । মূল মাহাত্ম হচ্ছে আল্লাহর হুকুম মানা। যখন যা করতে বলেছেন ঠিক তখন তা করা। যখন যা নিষেধ করেছেন তা না করা।

৩. অন্যের সম্পদ বা অধিকার হরণ থেকে বিরত রাখা। বৈধ জিনিষও সে সময় না করা মানে অবৈধ জিনিষের প্রশ্নই আসেনা। এভাবেই তাকওয়া ও আনুগত্যের অনুশীলন হয়ে যায়।

৪. আমরা দিতে শিখব, নিতে নয়। এ মাসে বেশী দান খয়রাতকে উৎসাহিত করা হয়েছে। তাছাড়া উপবাসের মাধ্যমে গরীবদের সাথে একাত্মতা ও সহমর্মিতা সৃষ্টি হয়।

৫. পাপ মোচন করে। হাদীসে এসেছে ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, এক জুমা থেকে আর এক জুমা এবং এক রমযান থেকে আরেক রমযান, এগুলো দুয়ের মাঝখানে যে পাপ হয় তা মুছে দেয় যদি কবিরা গুনাহ এড়িয়ে চলে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে রমযান সম্পর্কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি রমযানের ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় কিয়ামে রমযান অর্থাৎ তারাবীহর সালাত আদায় করবে তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে। “যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের (আত্মপর্যালোচনা/নিষ্ঠা/সাওযাব লাভের উদ্দেশ্যে ) সাথে রোযা রাখে, তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়”। বুখারী-মুসলিম।

৬. নিয়মানুবর্তীতা শেখায়। রোযা কঠিন ভাবে নিয়ম ও সময় মেনে চলে। নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট আগে ইফতার করা যাবেনা এক মিনিট পরে সেহরী খাওয়া যাবেনা।

৭. নাযাত ও মাগফিরাতের সুবর্ণ সুযোগ আনে। সাহল ইবনে সাআদ রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
জান্নাতে একটি দরজা আছে যার নাম রাইয়ান। কিয়ামত দিবসে সেখান দিয়ে সিয়াম পালনকারী প্রবেশ করবে। সে দরজা দিয়ে অন্য কেহ প্রবেশ করবে না। বলা হবে: সিয়াম পলনকারী কোথায়? তারা দাঁড়াবে, তারা ছাড়া আর কেহ প্রবেশ করবে না। তারা প্রবেশ করার পর দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। আর কেহ সে স্থান দিয়ে প্রবেশ করবে না। (বুখারী মুসলিম)।

৮. দ্বীনের জন্য ত্যাগ-কোরবানীর স্বাক্ষ বহন করে এই মাহে রমযান। ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয় এই মাসেই।

৯. রিয়ামুক্ত ইবাদত করার প্রশিক্ষণ দেয়। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেন, রোযাদার বান্দা আমার জন্যই খাদ্য-পানীয় ও প্রবৃত্তি বর্জন করেছে। রোজা আমারই জন্য। আমিই এর প্রতিদান দেব বা আমি নিজেই এর প্রতিদান।

রমযান মাসের ফজিলত

রমযান মাস মুসলিম জাতির প্রতি মহান আল্লাহর সীমাহীন অনুকম্পা ও অনুদানের অন্যতম মাস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ-মাসকে “শাহরুন-মুবারাক” বরকতময় মাস বলে অভিহিত করেছেন। এ মাসের রয়েছে বিশাল মর্যাদা ও ফজীলত, রয়েছে বিশেষ আমল। এ মাসকে কেন্দ্র করে মহান আল্লাহ প্রতিটি ঈমানদারের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উন্নতি ও কল্যাণ সাধনের সুযোগ অবধারিত করে দিয়েছেন। প্রতিটি মুসলমান যাতে এ মাসের মহা মূল্যবান প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে প্রতিশ্রুত প্রতিদান অর্জনে উদ্যোগী হয়, চেষ্টা-শ্রমের সবটুকু নিংড়ে দেয়, সেভাবে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করা প্রয়োজন। এ মাসের সাথে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুকনের সম্পর্ক রয়েছে, আর তা হলো রোজা পালন : হজ্জ যেমন জিলহজ্জ মাসের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে সে মাসের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে এমনি রোজা পালন রমযান মাসে হওয়ার কারণে এ মাসের মর্যাদা বেড়ে গেছে।

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : “হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেমনি ফরয করা হয়েছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। (সূরা বাকারাহ-১৮৩)

রমযান মাসের আগমনে মুসলিমগণ আনন্দ প্রকাশ করে থাকেন। আনন্দ প্রকাশ করাই স্বাভাবিক। পার্থিব কোন সম্পদের সাথে আল্লাহর এ অনুগ্রহের তুলনা চলে না, তা হবে এক ধরনের অবাস্তব কল্পনা। যখন রমযানের আগমন হত তখন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অতিশয় আনন্দিত হতেন, তার সাহাবাদের বলতেন : তোমাদের দ্বারে বরকতময় মাস রমযান এসেছে। এরপর তিনি এ মাসের কিছু ফজীলত বর্ণনা করে বলতেন : আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্য রোজা পালন ফরয করেছেন। এ মাসে আকাশের দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজাগুলো। অভিশপ্ত শয়তানকে বন্দি করা হয়। এ মাসে রয়েছে একটি রাত যা হাজার রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে মূলত সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল। (মাসনাদে আহমদ ও নাসায়ী)

আল্লাহর হাবীব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : যখন রমযানের প্রথম রাত্রি আগমন করে শয়তান এবং অবাধ্য জিনদের শৃঙ্খলিত করা হয়, জাহান্নামের সকল দুয়ার বন্ধ করে দেয়া হয়; খোলা রাখা হয় না কোন দ্বার, জান্নাতের দুয়ারগুলো খোলে দেয়া হয়; বন্ধ রাখা হয় না কোন তোরণ। এদিকে একজন ঘোষক ঘোষণা করেন, হে পুণ্যের অনুগামী, অগ্রসর হও। হে মন্দ-পথযাত্রী থেমে যাও। আবার অনেক ব্যক্তিকে আল্লাহ তা’আলা জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। আর এমনটি করা হয় রমযানের প্রতি রাতেই। (তিরমীযী)

আমাদের কর্তব্য হলো, আল্লাহর এ অনুগ্রহের মূল্যায়ন করতে চেষ্টা করা, এ মাসের ফজীলত ও তাতপর্য অনুধাবনে সচেষ্ট হওয়া ও ইবাদত-বন্দেগীসহ সকল কল্যাণকর কাজে নিয়োজিত থাকা। এ মাসের যে সকল ফজীলত রয়েছে তা হল : এ মাস হলো কুরআন নাযিলের মাস : আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ইরশাদ করেন : রমজান মাস, এতে নাযিল হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের দিশারী এবং স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। (সূরা বাকারাহ-১৮৪)

এ মাসে মানুষের হেদায়াত ও আলোকবর্তিকা যেমন নাযিল হয়েছে তেমনি আল্লাহর রহমত হিসেবে এসেছে রোজা। তাই এ দুই নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে বেশি বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন করা উচিত। প্রতি বছর রমযান মাসে জিবরাইল (আ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাকে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন। আর জীবনের শেষ রমযানে আল্লাহর রাসূল দু’বার পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করেছেন। (সহীহ মুসলিম)

 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই রমযান আসার পূর্ব থেকেই রমযানের জন্য প্রস্তুতি নিতেন। শাবান মাসে অধিকহারে নফল রোজা পালনের মাধ্যমে তিনি রমযানে সিয়াম সাধনার পূর্বানুশীলন করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে রমযানের শুভাগমনের সুসংবাদ দিতেন। তাঁদেরকে শোনাতেন রমযানের ফজিলতের কথা। যেন তারা রমযানে ইবাদত-বন্দেগীতে বেশি করে আত্মনিয়োগ করতে পারেন। নেকী অর্জনে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে প্রত্যয়ী হন। সুতরাং আমাদের কর্তব্য হল,এ মাস আসার আগেই এর যথার্থ মূল্যায়নের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। নীরবে এসে নীরবে চলে যাওয়ার পূর্বেই এ মহান অতিথির সমাদর করা। এ মাস যেন আমাদের বিপক্ষে দলীল না হয়ে দাঁড়ায় তার প্রস্তুতি সম্পন্ন করা। কারণ মাসটি পেয়েও যে এর উপযুক্ত মূল্য দিল না, বেশি বেশি পুণ্য আহরণ করতে পারল না এবং জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের পরোয়ানা পেল না, সে বড় হতভাগ্য। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হল এমন ব্যক্তি আল্লাহর ফেরেশতা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বদ দু’আর অধিকারী। কারণ এমন ব্যক্তির ওপর জিবরাইল (আ) লানত করেছেন আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সঙ্গে ‘আমীন’ বলেছেন!

এ মাসের আরো যে সকল ফজীলত রয়েছে তা হল :
. এ মাসের সাথে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুকনের সম্পর্ক রয়েছে, আর তা হল রোজা পালন : রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ইসলাম যে পাঁচটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত তার একটি হল রোজা পালন করা। এ রোজা জান্নাত লাভের একটি মাধ্যম, যেমন হাদীসে বর্ণিত রয়েছে : যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনল, নামাজ কায়েম করল, জাকাত আদায় করল, রোজা পালন করল রমজান মাসে, আল্লাহ তা ‘আলার কর্তব্য হল তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো। (বুখারী)

. রমজান মাসে রয়েছে লাইলাতুল কদর : আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতাগণ ও রুহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি, সে রজনি উষার আবির্ভাব পর্যন্ত। (সূরা কদর-৩/৫)

. রমজান মাস দোয়া কবুলের মাস : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : রমজান মাসে প্রত্যেক মুসলিমের দোয়া কবুল করা হয়। (মুসনাদ আহমদ) তাই প্রত্যেক মুসলমান এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজের কল্যাণের জন্য যেমন দোয়া-প্রার্থনা করবে, তেমনি সকল মুসলিমের কল্যাণ, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে দোয়া করবে।

. রমজান পাপ থেকে ক্ষমা লাভের মাস : যে ব্যক্তি রমজান মাস পেয়েও তার পাপসমূহ ক্ষমা করানো থেকে বঞ্চিত হলো আল্লাহর রাসূল তাকে ধিক্কার দিয়েছেন। তিনি বলেছেন : ঐ ব্যক্তির নাক ধুলায় ধূসরিত হোক যার কাছে রমজান মাস এসে চলে গেল অথচ তার পাপগুলো ক্ষমা করা হয়নি। (তিরমিজী) সত্যিই সে প্রকৃত পক্ষে সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত যে এ মাসেও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল।

. রমজান জাহান্নাম থেকে মুক্তির লাভের মাস : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : রমজান মাসের প্রথম রজনির যখন আগমন ঘটে তখন শয়তান ও অসৎ জিনগুলোকে বন্দি করা হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়, এ মাসে আর তা খোলা হয় না। জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, এ মাসে তা আর বন্ধ করা হয় না। প্রত্যেক রাতে একজন ঘোষণাকারী এ বলে ঘোষণা দিতে থাকে যে, হে সৎকর্মের অনুসন্ধানকারী তুমি অগ্রসর হও! হে অসৎ কাজের অনুসন্ধানকারী তুমি থেমে যাও! এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ তা’আলা জাহান্নাম থেকে বহু মানুষকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। (তিরমিজী)

 

 

. রমজান মাসে সৎকর্মের প্রতিদান বহু গুণে বৃদ্ধি করে দেয়া হয় : যেমন, রমজান মাসে ওমরাহ করলে একটি হজের সওয়াব পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, বরং, রমজান মাসে ওমরাহ করা আল্লাহর রাসূলের সাথে হজ আদায়ের মর্যাদা রাখে। এমনিভাবে সকল ইবাদত-বন্দেগীসহ সকল সৎকাজের প্রতিদান কয়েক গুণ বেশি দেয়া হয়।

. রমজান ধৈর্য ও সবরের মাস : এ মাসে ঈমানদার ব্যক্তিগণ খাওয়া-দাওয়া, বিবাহ-শাদী ও অন্যান্য সকল আচার-আচরণে যে ধৈর্য ও সবরের এত অধিক অনুশীলন করেন তা অন্য কোন মাসে বা অন্য কোন সময়ে করেন না। এমনিভাবে রোজা পালন করে যে ধৈর্যের প্রমাণ দেয়া হয় তা অন্য কোন ইবাদতে পাওয়া যায় না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন : ধৈর্যশীলদের তো বিনা হিসাবে পুরস্কার দেয়া হবে। (সূরা যুমার-১০)
আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন আমাদেরকে রমযান মাসের ফযীলত অর্জন করার তাওফীক দান করুন। আমীন ….

ছিয়াম বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

প্রশ্নঃ (০১) ছিয়াম ফরয হওয়ার হিকমত কি?

উত্তরঃ পবিত্র কুরআনের নিম্ন লিখিত আয়াত পাঠ করলেই আমরা জানতে পারি ছিয়াম ফরয হওয়ার হিকমত কি? আর তা হচ্ছে তাক্বওয়া বা আল্লাহ্‌ ভীতি অর্জন করা ও আল্লাহ্‌র ইবাদত করা। আল্লাহ্‌ বলেন,

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর ছিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে করে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার।(সূরা বাক্বারাঃ ১৮৩)

তাক্বওয়া হচ্ছে হারাম কাজ পরিত্যাগ করা। ব্যাপক অর্থে তাক্বওয়া হচ্ছে, আল্লাহ্‌র নির্দেশিত বিষয় বাস্তবায়ন করা, তাঁর নিষেধ থেকে দূরে থাকা। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

যে ব্যক্তি (রোযা রেখে) মিথ্যা কথা, মিথ্যার কারবার ও মূর্খতা পরিত্যাগ করল না, তার খানা-পিনা পরিহার করার মাঝে আল্লাহর কোন দরকার নেই।[1]

অতএব এ কথা নিশ্চিত হয়ে গেল যে, রোযাদার যাবতীয় ওয়াজিব বিষয় বাস্তবায়ন করবে এবং সবধরণের হারাম থেকে দূরে থাকবে। মানুষের গীবত করবে না, মিথ্যা বলবে না, চুগলখোরী করবে না, হারাম বেচা-কেনা করবে না, ধোঁকাবাজী করবে না। মোটকথা চরিত্র ধ্বংসকারী অন্যায় ও অশ্লীলতা বলতে যা বুঝায় সকল প্রকার হারাম থেকে বিরত থাকবে। আর একমাস এভাবে চলতে পারলে বছরের অবশিষ্ট সময় সঠিক পথে পরিচালিত হবে ইনশাআল্লাহ্‌।

কিন্তু আফসোসের বিষয় অধিকাংশ রোযাদার রামাযানের সাথে অন্য মাসের কোন পার্থক্য করে না। অভ্যাস অনুযায়ী ফরয কাজে উদাসীনতা প্রদর্শন করে, হালাল-হারামে কোন পার্থক্য নেই। তাকে দেখলে বুঝা যাবে না তার মধ্যে ছিয়ামের মর্যাদার কোন মূল্য আছে। অবশ্য এ সমস্ত বিষয় ছিয়ামকে ভঙ্গ করে দিবে না। কিন্তু নিঃসন্দেহে তার ছওয়াব বিনষ্ট করে দিবে।

সারাবিশ্বে একসাথে রামাযানের রোযা শুরু করা

প্রশ্নঃ (০২) মুসলিম জাতির একতার লক্ষ্যে কেউ কেউ চাঁদ দেখার বিষয়টিকে মক্কার সাথে সংশ্লিষ্ট করতে চায়। তারা বলে মক্কায় যখন রামাযান মাস শুরু হবে তখন বিশ্বের সবাই রোযা রাখবে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি?

উত্তরঃ বিষয়টি মহাকাশ গবেষণার দিক থেকে অসম্ভব। ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, চন্দ্র উদয়ের স্থান বিভিন্ন হয়ে থাকে। এ বিষয়ে অভিজ্ঞ বিদ্বানগণ ঐকমত্য। আর এই বিভিন্নতার দাবী হচ্ছে প্রত্যেক এলাকায় ভিন্ন রকম বিধান হবে। একথার পক্ষে দলীল কুরআন হাদীছ ও সাধারণ যুক্তি।

আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন,

“অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসে উপস্থিত হবে, সে যেন ছিয়াম পালন করে।(সূরা বাক্বারাঃ ১৮৫)

যদি পৃথিবীর শেষ সীমান্তের লোকেরা এ মাসে উপস্থিত না হয় অর্থাৎ চাঁদ না দেখে আর মক্কার লোকেরা চাঁদ দেখে, তবে কিভাবে এই আয়াত তাদের ক্ষেত্রে প্রজোয্য হবে যারা কিনা চাঁদই দেখেনি। আর নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

“তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ, চাঁদ দেখে রোযা ভঙ্গ কর।[2]

মক্কার অধিবাসীগণ যদি চাঁদ দেখে তবে পাকিস্তান এবং তার পূর্ববর্তী এলাকার অধিবাসীদের কিভাবে আমরা বাধ্য করতে পারি যে তারাও ছিয়াম পালন করবে? অথচ আমরা জানি যে, তাদের আকাশে চাঁদ দেখা যায়নি। আর নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিয়ামের বিষয়টি চাঁদের সাথে সংশ্লিষ্ট করে দিয়েছেন।

যুক্তিগত দলীল হচ্ছে, বিশুদ্ধ ক্বিয়াস যার বিরোধীতা করার অবকাশ নেই। আমরা ভাল ভাবে অবগত যে, পশ্চিম এলাকার অধিবাসীদের আগেই পূর্ব এলাকার অধিবাসীদের নিকট ফজর উদিত হয়। এখন পূর্ব এলাকায় ফজর উদিত হলে কি আমরা পশ্চিম এলাকার লোকদের বাধ্য করব একই সাথে খানা-পিনা থেকে বিরত হতে? অথচ তাদের ওখানে এখনও রাতের অনেক অংশ বাকী আছে? উত্তরঃ কখনই না। সূর্য যখন পূর্ব এলাকার অধিবাসীদের আকাশে অস্তমিত হয়, তখন পশ্চিম এলাকার দিগন্তে তো সূর্য দেখাই যাচ্ছে তাদেরকে কি আমরা ইফতার করতে বাধ্য করব? উত্তরঃ অবশ্যই না। অতএব চন্দ্রও সম্পূর্ণরূপে সূর্যের মতই। চন্দ্রের হিসাব মাসের সাথে সংশ্লিষ্ট। আর সূর্যের হিসাব দিনের সাথে সংশ্লিষ্ট। আল্লাহ্‌ বলেছেন,

ছিয়ামের রাতে স্ত্রীর সাথে সহবাস করা তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে; তারা তোমাদের জন্য আবরণ এবং তোমরা তাদের জন্য আবরণ। তোমরা যে নিজেদের খিয়ানত করছিলে, আল্লাহ্‌ তা পরিজ্ঞাত আছেন। এ জন্যে তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করলেন এবং তোমাদের (ভার) লাঘব করে দিলেন; অতএব এক্ষণে তোমরা (রোযার রাত্রেও) তাদের সাথে সহবাসে লিপ্ত হতে পার এবং আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য যা লিপিবদ্ধ করেছেন তা অনুসন্ধান কর। এবং প্রত্যুষে (রাতের) কালো রেখা হতে (ফজরের) সাদা রেখা প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত তোমরা খাও ও পান কর; অতঃপর রাত্রি সমাগম পর্যন্ত তোমরা রোযা পূর্ণ কর। তোমরা মসজিদে ইতেকাফ করার সময় (স্ত্রীদের) সাথে সহবাস করবে না; এটাই আল্লাহর সীমা, অতএব তোমরা তার নিকটেও যাবে না। এভাবে আল্লাহ্‌ মানব মন্ডলীর জন্যে তাঁর নিদর্শন সমূহ বিবৃত করেন, যেন তারা সংযত হয়।(সূরা বাক্বারা- ১৮৭)

সেই আল্লাহ্‌ই বলেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসে উপস্থিত হবে, সে যেন ছিয়াম পালন করে।অতএব যুক্তি ও দলীলের নিরীখে ছিয়াম ও ইফতারের ক্ষেত্রে প্রত্যেক স্থানের জন্য আলাদা বিধান হবে। যার সম্পর্ক হবে বাহ্যিক আলামত বা চিহ্ন দ্বারা যা আল্লাহ্‌ তা’আলা কুরআনে এবং নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সুন্নাতে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর তা হচ্ছে চাঁদ প্রত্যক্ষ করা এবং সূর্য বা ফজর প্রত্যক্ষ করা।

মানুষ যে এলাকায় থাকবে সে এলাকায় চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে রোযা ভঙ্গ করবে।

 

প্রশ্নঃ (০৩) রোযাদার যদি এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তর হয়, কিন্তু আগের দেশে ঈদের চাঁদ দেখার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সেকি এখন রোযা ভঙ্গ করবে? উল্লেখ্য যে, দ্বিতীয় দেশে ঈদের চাঁদ এখনও দেখা যায়নি।

উত্তরঃ কোন মানুষ যদি এক ইসলামী রাষ্ট্র থেকে অপর ইসলামী রাষ্ট্রে গমণ করে আর উক্ত রাষ্ট্রে ছিয়াম ভঙ্গের সময় না হয়ে থাকে, তবে সে তাদের সাথে ছিয়াম চালিয়ে যাবে, যে পর্যন্ত না তারা ছিয়াম ভঙ্গ করে। কেননা মানুষ যখন রোযা রাখে তখন রোযা রাখতে হবে, মানুষ যখন রোযা ভঙ্গ করে তখন রোযা ভঙ্গ করতে হবে। মানুষ যেদিন কুরবানীর ঈদ করে সেদিন কুরবানীর ঈদ করবে। যদিও তার একদিন বা দু’দিন বেশী হয়ে যায় তার জন্য এ বিধান প্রযোজ্য হবে। যেমন কোন লোক রোযা রেখে পশ্চিম দিকের কোন দেশে ভ্রমণে শুরু করল। সেখানে সূর্য অস্ত যেতে দেরী হচ্ছে। তখন সে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবশ্যই দেরী করবে। যদিও সময় সাধারণ দিনের চেয়ে দু’ঘন্টা বা তিন ঘন্টা বা তার চাইতে বেশী হয়।

দ্বিতীয় শহরে সে যখন পৌঁছেছে তখন সেখানে ঈদের চাঁদ দেখা যায়নি। অতএব সে অপেক্ষা করবে। কেননা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে চাঁদ না দেখে রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ, চাঁদ দেখে রোযা ভঙ্গ কর।[3]

এর বিপরীত কেউ যদি এমন দেশে সফর করে যেখানে নিজের দেশের পূর্বে চাঁদ দেখা গেছে (যেমন কেউ বাংলাদেশ থেকে সঊদী আরব সফর করে) তবে সে ঐ দেশের হিসাব অনুযায়ী রোযা ভঙ্গ করবে এবং ঈদের নামায পড়ে নিবে। আর যে কটা ছিয়াম বাকী থাকবে তা রামাযান শেষে কাযা আদায় করে নিবে। চাই একদিন হোক বা দুদিন। কেননা আরবী মাস ২৯ দিনের কম হবে না বা ৩০ দিনের বেশী হবে না। ২৯ দিন পূর্ণ না হলেও রোযা ভঙ্গ করবে এজন্য যে, চাঁদ দেখা গেছে। আর চাঁদ দেখা গেলে তো রোযা ভঙ্গ করা আবশ্যক। কিন্তু যেহেতু একটি রোযা কম হল তাই রামাযান শেষে তা কাযা করতে হবে। কেননা মাস ২৮ দিনে হয় না।

কিন্তু পূর্বেরমাসআলাটি এর বিপরীত। নতুন চাঁদ না দেখা পর্যন্ত রোযা ভঙ্গ করা জায়েয নয়। কেননা নতুন চাঁদ না উঠা পর্যন্ত রামাযান মাস বহাল। যদিও দুএকদিন বেশী হয়ে যায় তাতে কোন অসুবিধা নেই। সেটা এক দিনে কয়েক ঘন্টা বৃদ্ধি হওয়ার মত। (অতিরিক্ত রোযা নফল হিসেবে গণ্য হবে।)

কষ্টকর কঠিন কাজ করার কারণে রোযা ভঙ্গ করা জায়েয নয়।

 

প্রশ্নঃ ০৪) যে ব্যক্তি কষ্টকর কঠিন কাজ করার কারণে রোযা রাখতে অসুবিধা অনুভব করে তার কি রোযা ভঙ্গ করা জায়েয?

উত্তরঃ আমি যেটা মনে করি, কাজ করার কারণে রোযা ভঙ্গ করা জায়েয নয়, হারাম। রোযা রেখে কাজ করা যদি সম্ভব না হয়, তবে রামাযান মাসে ছুটি নিবে, অথবা কাজ কমিয়ে দিবে, যাতে করে রামাযানের ছিয়াম পালন করা সম্ভব হয়। কেননা রামাযানের ছিয়াম ইসলামের অন্যতম একটি রুকন। যার মধ্যে শিথীলতা করা জায়েয নয়।

ঋতুর দিনগুলোতে ছেড়ে দেয়া রোযা কাযা আদায় করা আবশ্যক।

 

প্রশ্নঃ (০৫) জনৈক বালিকা ছোট বয়সে ঋতুবতী হয়ে গেছে। সে অজ্ঞতা বশতঃ ঋতুর দিনগুলোতে রোযা পালন করেছে। এখন তার করণীয় কি?

উত্তরঃ তার উপর আবশ্যক হচ্ছে, ঋতু অবস্থায় যে কয়দিনের ছিয়াম আদায় করেছে সেগুলোর কাযা আদায় করা। কেননা ঋতু অবস্থায় ছিয়াম পালন করলে বিশুদ্ধ হবে না এবং গ্রহণীয় হবে না। যদিও তা অজ্ঞতা বশতঃ হয়ে থাকে। তাছাড়া পরবর্তীতে যে কোন সময় তা কাযা করা সম্ভব। কাযা আদায় করার জন্য নির্দিষ্ট কোন সময় নেই।

এর বিপরীত আরেকটি মাসআলা হচ্ছে, অল্প বয়সে জনৈক বালিকা ঋতুবতী হয়ে গেছে। কিন্তু লজ্জার কারণে বিষয়টি কারো সামনে প্রকাশ করেনি এবং তার ছিয়ামও পালন করেনি। এর উপর ওয়াজিব হচ্ছে, উক্ত মাসের ছিয়াম কাযা আদায় করা। কেননা নারী ঋতুবতী হয়ে গেলেই প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে যায় এবং শরীয়তের যাবতীয় বিধি-বিধান পালন করা তার উপর ফরয হয়ে যায়।

প্রশ্নঃ (০৬) জীবিকা নির্বাহের কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে ছিয়াম ভঙ্গ করার বিধান কি?

উত্তরঃ যে ব্যক্তি রামাযানের ছিয়াম পরিত্যাগ করে এই যুক্তিতে যে, সে নিজের এবং পরিবারের জীবিকা উপার্জনে ব্যস্ত। সে যদি এই তা’বীল বা ব্যাখ্যা করে যে, অসুস্থ ব্যক্তি যেমন রোযা ভঙ্গ না করলে বেঁচে থাকতে অক্ষম তেমনি আমিও তো দরিদ্র অভাবী, জীবিকা উপার্জন করতে হলে আমাকে রোযা ভঙ্গ করতে হবে, তবে এই যুক্তি খোঁড়া এবং নিঃসন্দেহে এ ব্যক্তি মূর্খ। অতএব অজ্ঞতার কারণে এবং অপব্যাখ্যার কারণে সে উক্ত সময়ের কাযা আদায় করবে যদি সে জীবিত থাকে। জীবিত না থাকলে তার পরিবার তার পক্ষ থেকে কাযা আদায় করে দিবে। কেউ কাযা আদায় না করলে তার পক্ষ থেকে প্রতিদিনের বিনিময়ে একজন করে মিসকীনকে খাদ্য খাওয়াবে।

কিন্তু যদি কোন ধরণের ব্যাখ্যা না করে ইচ্ছাকৃতভাবে ছিয়াম পরিত্যাগ করে থাকে, তবে বিদ্বানদের মতামত সমূহের মধ্যে থেকে বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, সময়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ইবাদত সমূহ বিনা ওযরে ইচ্ছাকৃতভাবে সময় অতিবাহিত করে আদায় করলে তা কবূল হবে না। তাই এ লোকের উপর আবশ্যক হচ্ছে, আল্লাহ্‌র কাছে তওবা করা, নেক আমল ও নফল ইবাদত সমূহ বেশী বেশী সম্পাদন করা ও ইস্তেগফার করা। এর দলীল হচ্ছে, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন যে ব্যক্তি এমন আমল করবে যাতে আমাদের নির্দেশনা নেই। তবে তা প্রত্যাখ্যাত।[4] সময়ের সাথে নির্দিষ্ট ইবাদত সমূহ যেমন সময়ের পূর্বে আদায় করলে কবূল হবে না। অনুরূপভাবে সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও তা গ্রহণীয় হবে না। কিন্তু যদি অজ্ঞতা বা ভুলের কোন ওযর থাকে, তবে ভুল সম্পর্কে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

যে ব্যক্তি ছালাত আদায় না করে ঘুমিয়ে থাকে বা ভুলে যায়, তবে স্মরণ হলেই সে তা আদায় করবে। এটাই তার কাফ্‌ফারা।[5]

 

প্রশ্নঃ (০৭) রোযা ভঙ্গের গ্রহণযোগ্য কারণ কি কি?

উত্তরঃ রোযা ভঙ্গের কারণ সমূহ হচ্ছেঃ

১) অসুস্থতা,

২) সফর। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ্‌ বলেন,

আর যে ব্যক্তি অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে (সে রোযা ভঙ্গ করে) অন্য দিনে তা কাযা আদায় করে নিবে।(সূরা বাক্বারাঃ ১৮৫)

৩) গর্ভবতী নারীর নিজের বা শিশুর জীবনের আশংকা করলে রোযা ভঙ্গ করবে।

৪) সন্তানকে দুগ্ধদানকারীনী নারী যদি রোযা রাখলে নিজের বা সন্তানের জীবনের আশংকা করে তবে রোযা ভঙ্গ করবে।

৫) কোন বিপদগ্রস্ত মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে রোযা ভঙ্গ করা: যেমন পানিতে ডুবন্ত ব্যক্তিকে উদ্ধার, আগুন থেকে বাঁচাতে গিয়ে দরকার হলে রোযা ভঙ্গ করা।

৬) আল্লাহ্‌র পথে জিহাদে থাকার সময় শরীরে শক্তি বজায় রাখার জন্য রোযা ভঙ্গ করা। কেননা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কা বিজয়ের সময় ছাহাবীদেরকে বলেছিলেন,

আগামীকাল তোমরা শত্রুর মোকাবেলা করবে, রোযা ভঙ্গ করলে তোমরা অধিক শক্তিশালী থাকবে, তাই তোমরা রোযা ভঙ্গ কর।[6]

বৈধ কোন কারণে রোযা ভঙ্গ করলে দিনের বাকী অংশ রোযা অবস্থায় থাকা আবশ্যক নয়। কেননা সে তো গ্রহণযোগ্য ওযরের কারণেই রোযা ভঙ্গ করেছে। এজন্য এ মাসআলায় বিশুদ্ধ কথা হচ্ছেঃ কোন রুগী যদি অসুস্থতার কারণে দিনে রোযা ভঙ্গ করে আর দিন শেষ হওয়ার আগেই সুস্থ হয়ে যায়, তবে দিনের বাকী অংশ রোযা অবস্থায় থাকার কোন আবশ্যকতা নেই। কোন মুসাফির যদি রোযা ভঙ্গ অবস্থায় দিন থাকতেই সফর থেকে ফিরে আসে তারও দিনের বাকী অংশ রোযা অবস্থায় থাকার আবশ্যকতা নেই। অনুরূপ বিধান ঋতুবতী নারীর। কেননা এরা সবাই বৈধ কারণে রোযা ভঙ্গ করেছে। তাই ঐ দিবস তাদের জন্যই। তাতে তাদের প্রতি ছিয়ামের আবশ্যকতা নেই। কেননা শরীয়ত তাদেরকে রোযা ভঙ্গের অনুমতি প্রদান করে আবার তা আবশ্যক করবে না।

এর বিপরীত মাসআলা হচ্ছে, রামাযান মাসের চাঁদ দেখা গেছে একথা যদি দিনের বেলায় প্রমাণিত হয়, তবে খবর পাওয়ার সাথে সাথে রোযার নিয়ত করে নিতে হবে এবং দিনের বাকী সময় রোযা অবস্থায় কাটাতে হবে। উভয় মাসআলায় পার্থক্য সুস্পষ্ট। কেননা যখন কিনা দিনের বেলায় রামাযান মাস শুরু হওয়ার কথা প্রমাণিত হয়েছে, তখন তাদের উপর সে দিনের ছিয়াম পালন করা ওয়াজিব হয়ে গেছে। কিন্তু না জানার কারণে তাদের ওযর গ্রহণযোগ্য এবং তাদের ছিয়াম বিশুদ্ধ। এই কারণে তারা যদি জানতে পারত যে আজ রামাযান শুরু হয়েছে, তবে রোযা রাখা তাদের জন্য আবশ্যক হত।

ফজর হওয়ার পর যদি জানতে পারে যে রামাযান মাস শুরু হয়েছে, তখন কি করবে?

 

প্রশ্নঃ (০৮) রামাযান মাস শুরু হয়েছে কিনা এসংবাদ না পেয়েই জনৈক ব্যক্তি রাতে ঘুমিয়ে পড়ে। রাতে সে ছিয়ামের নিয়ত করেনি ফজর হয়ে গেছে। ফজরের সময় সে জানতে পারল আজ রামাযানের প্রথম দিন। এ অবস্থায় তার করণীয় কি? উক্ত দিনের ছিয়াম কি কাযা আদায় করতে হবে?

উত্তরঃ যখন সে জানতে পারবে তখনই রোযার নিয়ত করে ফেলবে এবং ছিয়াম পালন করবে। অধিকাংশ বিদ্বানের মতে এ দিনটির ছিয়াম পরে সে কাযা আদায় করবে। তবে ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) এতে বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেন, জানার সাথে নিয়তের সম্পর্ক। এ লোক তো জানতেই পারেনি। অতএব তার ওযর গ্রহণযোগ্য। সে জানতে পারলে রাতে কখনই ছিয়ামের নিয়ত করা ছাড়তো না। কিন্তু সে তো ছিল অজ্ঞ। আর অজ্ঞ ব্যক্তির ওযর গ্রহণযোগ্য। অতএব জানার পর যদি রোযার নিয়ত করে ফেলে তবে ছিয়াম বিশুদ্ধ। তাকে কাযা আদায় করতে হবে না।

অধিকাংশ বিদ্বান বলেন, তাকে উক্ত দিনের রোযা রাখা আবশ্যক এবং তার কাযা আদায় করাও আবশ্যক। এর কারণ হিসেবে বলেন, এ লোকের দিনের একটি অংশ নিয়ত ছাড়া অতিবাহিত হয়েছে। তাই তাকে কাযা আদায় করতে হবে।

আমি মনে করি, সতর্কতা বশতঃ উক্ত দিনের রোযা কাযা করে নেয়াই উচিত।

রোযা ভঙ্গের ওযর শেষ হয়ে গেলে কি দিনের বাকী অংশ রোযা অবস্থায় কাটাবে?

 

প্রশ্নঃ (০৯) কারণ বশতঃ কোন ব্যক্তি যদি রোযা ভঙ্গ করে আর দিন শেষ হওয়ার আগেই উক্ত ওযর দূর হয়ে যায়। সে কি দিনের বাকী অংশ রোযা অবস্থায় কাটাবে?

উত্তরঃ না, দিনের বাকী অংশ ছিয়াম অবস্থায় থাকা আবশ্যক নয়। তবে রামাযান শেষে উক্ত দিবসের কাযা তাকে আদায় করতে হবে। কেননা শরীয়ত অনুমদিত কারণেই সে ছিয়াম ভঙ্গ করেছে। উদাহরণ স্বরূপ অসুস্থ ব্যক্তির অপারগতার কারণে শরীয়ত তাকে ঔষুধ সেবনের অনুমতি দিয়েছে। ঔষুধ সেবন করা মানেই রোযা ভঙ্গ। অতএব পূর্ণ এই দিনটির ছিয়াম তার উপর আবশ্যক নয়। দিনের বাকী অংশ রোযা অবস্থায় থাকার অবশ্যকতায় শরীয়ত সম্মত কোন ফায়েদা নেই। যেখানে কোন উপকার নেই তা আবশ্যক করাও চলে না।

উদাহরণ: জনৈক ব্যক্তি দেখল একজন লোক পানিতে ডুবে যাচ্ছে। সে বলছে আমি যদি পানি পান করি তবে এই ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে পারব। পানি পান না করলে তাকে বাঁচানো আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় সে পানি পান করবে এবং তাকে পানিতে ডুবা থেকে উদ্ধার করবে। অতঃপর দিনের অবশিষ্ট অংশ খানা-পিনা করবে। এ দিনের সম্মান তার জন্য আর নেই। কেননা শরীয়তের দাবী অনুযায়ীই রোযা ভঙ্গ করা তার জন্য বৈধ হয়েছে। তাই দিনের বাকী অংশ রোযা রাখা আবশ্যক নয়।

যদি কোন লোক অসুস্থ থাকে তাকে কি আমরা বলব, ক্ষুধার্ত না হলে খানা খাবে না? পিপাসিত না হলে পানি পান করবে না? অর্থাৎ- প্রয়োজন না হলে খানা-পিনা করবে না? না, এরূপ বলব না। কেননা এ লোককে তো রোযা ভঙ্গের অনুমতি দেয়া হয়েছে। অতএব শরঈ দলীলের ভিত্তিতে রামাযানের রোযা ভঙ্গকারী প্রত্যেক ব্যক্তির দিনের অবশিষ্ট অংশ রোযা অবস্থায় অতিবাহিত করা আবশ্যক নয়।

এর বিপরীত মাসআলায় বিপরীত সমাধান। অর্থাৎ- বিনা ওযরে যদি রোযা ভঙ্গ করে তবে তাকে দিনের অবশিষ্ট অংশ রোযা অবস্থায় থাকতে হবে। কেননা রোযা ভঙ্গ করা তার জন্য বৈধ ছিল না। শরীয়তের অনুমতি ছাড়াই সে এদিনের সম্মান নষ্ট করেছে। অতএব দিনের বাকী অংশ ছিয়াম পালন করা যেমন আবশ্যক তেমনি কাযা আদায় করাও যরূরী।

 

কঠিন রোগে আক্রান্ত হলে রোযা ভঙ্গ করে মিসকীন খাওয়াবে।

 

প্রশ্নঃ (১০) জনৈক মহিলা কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে ডাক্তারগণ তাকে রোযা রাখতে নিষেধ করেছে। এর বিধান কি?

উত্তরঃ আল্লাহ্‌ বলেন,

রামাযান হচ্ছে সেই মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়াত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ। আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ অথবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করে নিবে। আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য কঠিন কামনা করেন না।(সূরা বাক্বারাঃ ১৮৫)

মানুষ যদি এমন রোগে আক্রান্ত হয় যা থেকে সুস্থ হওয়ার কোন আশা নেই। তবে প্রতিদিনের বিনিময়ে একজন করে মিসকীনকে খাদ্য খাওয়াবে। খাদ্য দেয়ার পদ্ধতি হচ্ছে, মিসকীনকে পরিমাণমত চাউল প্রদান করা এবং সাথে মাংস ইত্যাদি তরকারী হিসেবে দেয়া উত্তম। অথবা দুপুরে বা রাতে তাকে একবার খেতে দিবে। এটা হচ্ছে ঐ রুগীর ক্ষেত্রে যার সুস্থ হওয়ার কোন সম্ভবনা নেই। আর নারী এ ধরণের রোগে আক্রান্ত। তাই আবশ্যক হচ্ছে সে প্রতিদিনের জন্য একজন করে মিসকীনকে খাদ্য প্রদান করবে।

 

প্রশ্নঃ (১১) কখন এবং কিভাবে মুসাফির নামায ও রোযা আদায় করবে?

উত্তরঃ মুসাফির নিজ শহর থেকে বের হওয়ার পর থেকে নিয়ে প্রত্যাবর্তন করা পর্যন্ত দু’দু রাকাত নামায আদায় করবে। আয়েশা (রাঃ) বলেন,

সর্বপ্রথম যে নামায ফরয করা হয়েছিল তা হচ্ছে দু’রাকাত। সফরের নামাযকে ঐভাবেই রাখা হয়েছে এবং গৃহে অবস্থানের সময় নামাযকে পূর্ণ (চার রাকাত) করা হয়েছে। অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে, গৃহে অবস্থানের সময় নামায বৃদ্ধি করা হয়েছে।[7]

আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, আমরা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সাথে মদীনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। তিনি মদীনা ফিরে আসা পর্যন্ত দুদু রাকাত করে নামায আদায় করলেন।

কিন্তু মুসাফির যদি স্থানীয় ইমামের সাথে নামায আদায় করে তবে পূর্ণ চার রাকাতই পড়বে। চাই নামাযের প্রথম থেকে ইমামের সাথে থাকুক বা পরে এসে অংশ গ্রহণ করুক। কেননা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সাধারণ বাণী একথার দলীল।

যখন নামাযের ইকামত প্রদান করা হয় তখন হেঁটে হেঁটে ধীর-স্থীর এবং প্রশান্তির সাথে নামাযের দিকে আগমণ করবে। তাড়াহুড়া করবে না। অতঃপর নামাযের যতটুকু অংশ পাবে আদায় করবে। আর যা ছুটে যাবে তা পরে পূর্ণ করে নিবে।[8]

এ হাদীছটি স্থানীয় ইমামের পিছনে নামায আদায়কারী মুসাফিরদেরও শামিল করে। ইবনু আব্বাস (রাঃ)কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এটা কি কথা মুসাফির একাকী নামায পড়লে দু’রাকাত পড়বে আর স্থানীয় ইমামের পিছনে পড়লে চার রাকাত পড়বে? তিনি বললেন, এটা সুন্নাত।

মুসাফিরের জন্য জামাআতের নামায রহিত নয়। কেননা আল্লাহ্‌ বলেনঃ

আর যখন আপনি তাদের সাথে থাকেন আর তাদেরকে জামাআতের সাথে নামায পড়ান, তবে তা এইভাবে হবে যে, তাদের মধ্যে থেকে একদল আপনার সাথে নামাযে দাঁড়াবে এবং নিজেদের অস্ত্র-শস্ত্র সাথে রাখবে। অনন্তর যখন তারা সিজদা করবে (এক রাকাআত পূর্ণ করবে), তখন তারা আপনাদের পিছনে চলে যাবে এবং অন্য দল যারা এখনও নামায পড়েনি তারা আসবে এবং আপনার সাথে নামায পড়ে নিবে।(সূরা নিসাঃ ১০২)

অতএব মুসাফির যদি নিজ শহর ছেড়ে অন্য শহরে অবস্থান করে, তবে আযান শুনলেই মসজিদে জামাআতের নামাযে উপস্থিত হবে। তবে যদি মসজিদ থেকে বেশী দূরে থাকে বা সফর সঙ্গীদের ক্ষতির আশংকা করে তবে মসজিদে না গেলেও চলবে। কেননা সাধারণ দলীল সমূহ একথাই প্রমাণ করে যে, আযান বা এক্বামত শুনলেই জামাআতে উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব।

নফল বা সুন্নাত নামাযের ক্ষেত্রেঃ মুসাফির যোহর, মাগরিব ও এশার সুন্নাত ছাড়া সবধরণের নফল ও সুন্নাত আদায় করবে। রাতের নফল (তাহাজ্জুদ), বিতর, ফজরের সুন্নাত, চাশত, তাহিয়্যাতুল ওযু, তাহিয়্যাতুল মসজিদ, সফর থেকে ফেরত এসে দু’রাকাত নামায আদায় করবে।

দু’নামায একত্রিত করার বিধান হচ্ছেঃ সফর যদি চলমান থাকে তবে উত্তম হচ্ছে দু’নামাযকে একত্রিত করা। যোহর ও আছর এবং মাগরিব ও এশা একত্রিত আদায় করবে। প্রথম নামাযের সময়ই দু’নামায একত্রিত আদায় করবে অথবা দ্বিতীয় নামাযের সময় দু’নামাযকে একত্রিত করবে। যেভাবে তার জন্য সুবিধা হয় সেভাবে করবে।

কিন্তু সফরে গিয়ে কোন জায়গায় যদি অবস্থান করে তবে উত্তম হচ্ছে দু’নামাযকে একত্রিত না করা। একত্রিত করলেও কোন অসুবিধা নেই। কেননা উভয়টিই রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে প্রমাণিত আছে।

ছিয়ামের ক্ষেত্রে মুসাফিরের জন্য উত্তম হচ্ছে ছিয়াম পালন করা। ছিয়াম ভঙ্গ করলেও কোন অসুবিধা নেই। পরে উক্ত দিনগুলোর কাযা আদায় করে নিবে। তবে ছিয়াম ভঙ্গ করা যদি বেশী আরাম দায়ক হয় তাহলে ছিয়াম ভঙ্গ করাই উত্তম। কেননা আল্লাহ্‌ বান্দাকে যে ছুটি দিয়েছেন তা গ্রহণ করা তিনি পসন্দ করেন। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের জন্য।

 

প্রশ্নঃ (১২) সফর অবস্থায় কষ্ট হলে রোযা রাখার বিধান কি?

উত্তরঃ সফর অবস্থায় যদি এমন কষ্ট হয় যা সহ্য করা সম্ভব, তবে সে সময় রোযা রাখা মাকরূহ। কেননা একদা সফরে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখলেন জনৈক ব্যক্তির পাশে লোকজন ভীড় করছে এবং তাকে ছাঁয়া করছে। তিনি বললেন, এর কি হয়েছে? তারা বলল, লোকটি রোযাদার। তখন তিনি বললেন,  সফর অবস্থায় ছিয়াম পালন করা কোন পূণ্যের কাজ নয়।[9]

কিন্তু সফরে রোযা রাখা যদি অধিক কষ্টদায়ক হয় তবে ওয়াজিব হচ্ছে রোযা ভঙ্গ করা। কেননা সফর অবস্থায় লোকেরা যখন নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর নিকট অভিযোগ করল যে তাদের কষ্ট হচ্ছে তখন তিনি রোযা ভঙ্গ করলেন। অতঃপর বলা হল, কিছু লোক এখনও রোযা রেখেছে। তিনি বললেন,  ওরা নাফরমান, ওরা নাফরমান।[10]

কিন্তু রোযা রাখতে যার কোন কষ্ট হবে না, তার জন্য উত্তম হচ্ছে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর অনুসরণ করে রোযা পালন করা। কেননা সফর অবস্থায় তিনি রোযা রাখতেন। আবু দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,

একদা রামাযান মাসে কঠিন গরমের সময় আমরা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সাথে সফরে ছিলাম। তখন আমাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আবদুল্লাহ্‌ বিন রাওয়াহা ছাড়া আর কেউ রোযা রাখেন নি।[11]

সফর আরাম দায়ক হলে রোযা ভঙ্গ না করাই উত্তম।

 

প্রশ্নঃ (১৩) আধুনিক যুগের যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত ও আরাম দায়ক হওয়ার কারণে সফর অবস্থায় রোযা রাখা মুসাফিরের জন্য কষ্টকর নয়। এ অবস্থায় রোযা রাখার বিধান কি?

উত্তরঃ মুসাফির রোযা রাখা ও ভঙ্গ করার ব্যাপারে ইচ্ছাধীন। আল্লাহ্‌ বলেন,

আর যে লোক অসুস্থ অথবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করে নিবে।(সূরা বাক্বারাঃ ১৮৫) ছাহাবায়ে কেরাম নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সাথে সফরে থাকলে কেউ রোযা রাখতেন কেউ রোযা ভঙ্গ করতেন। কোন রোযা ভঙ্গকারী অপর রোযাদারকে দোষারোপ করতেন না, রোযাদারও রোযা ভঙ্গকারীকে দোষারোপ করতেন না। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও সফর অবস্থায় রোযা রেখেছেন। আবু দারদা (রাঃ) বলেন, একদা রামাযান মাসে কঠিন গরমের সময় আমরা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সাথে সফরে ছিলাম। তখন আমাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আবদুল্লাহ্‌ বিন রাওয়াহা ছাড়া আর কেউ রোযা রাখে নি।[12]

মুসাফিরের জন্য মূলনীতি হচ্ছে, সে রোযা রাখা ও ভঙ্গ করার ব্যাপারে ইচ্ছাধীন। কিন্তু কষ্ট না হলে রোযা রাখাই উত্তম। কেননা এতে তিনটি উপকারীতা রয়েছেঃ

প্রথমতঃ রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর অনুসরণ।

দ্বিতীয়তঃ রোযা রাখতে সহজতা। কেননা সমস্ত মানুষ যখন রোযা রাখে তখন সবার সাথে রোযা রাখা অনেক সহজ।

তৃতীয়তঃ দ্রুত নিজেকে যিম্মামুক্ত করা।

কিন্তু কষ্টকর হলে রোযা রাখবে না। এ অবস্থায় রোযা রাখা পূণ্যেরও কাজ নয়। কেননা এক সফরে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দেখলেন জনৈক ব্যক্তির পাশে লোকজন ভীড় করছে এবং তাকে ছাঁয়া দিচ্ছে। তিনি বললেন, এর কি হয়েছে? তারা বলল, লোকটি রোযাদার। তখন তিনি বললেন সফর অবস্থায় ছিয়াম পালন করা কোন পূণ্যের কাজ নয়।[13]

এভিত্তিতে আমরা বলব, বর্তমান যুগে সাধারণতঃ সফরে তেমন কোন কষ্ট হয় না। তাই ছিয়াম পালন করাই উত্তম।

মুসাফির মক্কায় পৌঁছে রোযা ছেড়ে দিয়ে প্রশান্তির সাথে ওমরা করতে পারে।

 

প্রশ্নঃ (১৪) রোযা অবস্থায় মুসাফির যদি মক্কায় পৌঁছে। তবে ওমরা আদায় করতে শক্তি পাওয়ার জন্য রোযা ভঙ্গ করা জায়েয হবে কি?

উত্তরঃ নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কা বিজয়ের সময় রামাযান মাসের বিশ তারিখে মক্কায় প্রবেশ করেন। সে সময় তিনি রোযা ভঙ্গ অবস্থায় ছিলেন। সেখানে দু’দু রাকআত করে নামায কসর আদায় করেছেন। আর মক্কাবাসীদের বলেছেন, হে মক্কাবাসীগণ! তোমরা নামায পূর্ণ করে নাও। কেননা আমরা মুসাফির।[14] ছহীহ্‌ বুখারীতে একথাও প্রমাণিত হয়েছে, তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাসের অবশিষ্ট দিনগুলো রোযা ভঙ্গ অবস্থাতেই অতিবাহিত করেছেন। কেননা তিনি ছিলেন মুসাফির।

তাই ওমরাকারী মক্কা পৌঁছলেই তার সফর শেষ হয়ে যায় না। যদি রোযা ভঙ্গ অবস্থায় মক্কা পৌঁছে থাকে, তবে দিনের বাকী অংশ পানাহার ত্যাগ করা আবশ্যক নয়। কিন্তু বর্তমান যুগে যেহেতু সফর আরাম দায়ক তাই রোযা রাখাও তেমন কষ্টকর নয়। সেহেতু কেউ যদি রোযা রেখে মক্কায় পৌঁছে অত্যধিক ক্লান্তি অনুভব করে, তখন চিন্তা করে আমি কি রোযা পূর্ণ করে ইফতারের পর ওমরার কাজ শুরু করবো? নাকি রোযা ভঙ্গ করব এবং সর্বপ্রথম ওমরা আদায় করে নিব?

এ অবস্থায় আমরা তাকে বলব, আপনার জন্য উত্তম হচ্ছে, সুস্থাবস্থায় ওমরা পালন করার জন্য রোযা ভঙ্গ করা। কেননা হজ্জ-ওমরা আদায়কারীর জন্য সুন্নাত হচ্ছে, উক্ত উদ্দেশ্যে মক্কা আগমণ করলে, সেখানে পৌঁছার সাথে সাথেই হজ্জ-ওমরার কাজে আত্মনিয়োগ করা। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইহরাম অবস্থায় মক্কা আগমণ করলে দ্রুত মসজিদে হারামে গমণ করতেন। এমনকি আরোহীকে মসজিদের নিকটবর্তী স্থানে বসাতেন।

অতএব ওমরাকারীর জন্য উত্তম হচ্ছে, দিনের বেলায় কর্মশক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে রোযা ভঙ্গ করে ওমরা পালন করা। রাত পর্যন্ত অপেক্ষা না করা।

ছহীহ্‌ সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কা বিজয়ের জন্য যখন সফরে ছিলেন এবং তিনি রোযা অবস্থায় ছিলেন, তখন কতিপয় লোক এসে অভিযোগ করল, রোযা রাখতে তাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। আপনি কি করছেন এটা দেখার অপেক্ষায় আছে তারা। তখন সময়টি ছিল আছরের পর। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পানি চাইলেন এবং পান করলেন। লোকেরা সবাই দেখল।[15] অতএব নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সফর অবস্থায় দিনের শেষ প্রহরে রোযা ভঙ্গ করলেন। একাজ যে জায়েয একথা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে তিনি এরূপ করেছেন।

উল্লেখ্য যে, সফরে কষ্ট স্বীকার করে কিছু লোক যে ছিয়াম পালন করতেই থাকে নিঃসন্দেহে তা সুন্নাহ্‌ বিরোধী কাজ। তার ব্যাপারেই নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ সফর অবস্থায় ছিয়াম পালন করা কোন পূণ্যের কাজ নয়।[16]

 

প্রশ্নঃ (১৫) সন্তানকে দুগ্ধদানকারীনী কি রোযা ভঙ্গ করতে পারবে? ভঙ্গ করলে কিভাবে কাযা আদায় করবে? নাকি রোযার বিনিময়ে খাদ্য দান করবে?

উত্তরঃ দুগ্ধদানকারীনী রোযা রাখার কারণে যদি সন্তানের জীবনের আশংকা করে অর্থাৎ রোযা রাখলে স্তনে দুধ কমে যাবে ফলে শিশু ক্ষতিগ্রস্থ হবে, তবে মায়ের রোযা ভঙ্গ করা জায়েয। কিন্তু পরবর্তীতে তার কাযা আদায় করে নিবে। কেননা এ অবস্থায় সে অসুস্থ ব্যক্তির অনুরূপ। যার সম্পর্কে আল্লাহ্‌ বলেন,

আর যে লোক অসুস্থ অথবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করে নিবে।(সূরা বাক্বারাঃ ১৮৫)

অতএব রোযা রাখার ব্যাপারে যখনই বাধা দূর হবে তখনই কাযা আদায় করবে। চাই তা শীতকালে অপেক্ষাকৃত ছোট দিনে হোক অথবা সম্ভব না হলে পরবর্তী বছর হোক। কিন্তু ফিদ্‌ইয়া স্বরপ মিসকীন খাওয়ানো জায়েয হবে না। তবে ওযর যদি চলমান থাকে অর্থাৎ সার্বক্ষণিক রোযা রাখায় বাধা দেখা যায় যা বাধা দূর হওয়ার সম্ভবনা না থাকে, তখন প্রতিটি রোযার বদলে একজন করে মিসকীনকে খাওয়াবে।

 

প্রশ্নঃ (১৬) ক্ষুধা-পিপাসা ও অতিরিক্ত ক্লান্তির সাথে রোযা পালন করলে রোযার বিশুদ্ধতায় কি কোন প্রভাব পড়বে?

উত্তরঃ ক্ষুধা-পিপাসা ও অতিরিক্ত ক্লান্তির সাথে রোযা পালন করলে রোযার বিশুদ্ধতায় এর কোন প্রভাব পড়বে না। বরং এতে অতিরিক্ত ছওয়াব পাওয়া যাবে। কেননা রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আয়েশা (রাঃ)কে বলেছিলেন, তোমার ক্লান্তি ও কষ্ট অনুযায়ী তুমি ছওয়াব পাবে।[17] অতএব আল্লাহ্‌র আনুগত্যের ক্ষেত্রে মানুষের ক্লান্তি যত বেশী হবে ততই তার প্রতিদান বেশী হবে। তবে রোযার ক্লান্তি দূর করার জন্য মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালা বা ঠান্ডা শীতল স্থানে আরাম গ্রহণ করা যেতে পারে।

রামাযানের পূরা মাসের রোযার নিয়ত একবার করে নিলেই চলবে।

প্রশ্নঃ (১৭) রামাযানের প্রত্যেক দিনের জন্য আলাদা আলাদাভাবে কি নিয়ত করা আবশ্যক? নাকি পূর্ণ মাসের নিয়ত একবার করে নিলেই হবে?

উত্তরঃ রামাযানের প্রথমে পূর্ণ মাসের জন্য একবার নিয়ত করলেই যথেষ্ট হবে। কেননা রোযাদার যদি প্রতিদিনের জন্য রাতে নিয়ত না করে, তবে তা রামাযানের প্রথমের নিয়তের শামিল হয়ে তার ছিয়াম বিশুদ্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু সফর, অসুস্থতা প্রভৃতি দ্বারা যদি মাসের মধ্যখানে বিচ্ছিন্নতা আসে, তবে নতুন করে আবার নিয়ত আবশ্যক। কেননা মাসের প্রথমে সে যে ছিয়ামের নিয়ত করেছিল তা সফর বা অসুস্থতা প্রভৃতির মাধ্যমে ভঙ্গ করে ফেলেছে।

প্রশ্নঃ (১৮) রোযা ভঙ্গের জন্য অন্তরে দৃঢ় নিয়ত করলেই কি রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে?

উত্তরঃ একথা সর্বজন বিদিত যে, ছিয়াম হচ্ছে নিয়ত এবং পরিত্যাগের সমষ্টির নাম। অর্থাৎ রোযা বিনষ্টকারী যাবতীয় বস্তু পরিত্যাগ করে রোযাদার রোযার দ্বারা আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের নিয়ত করবে। কিন্তু সত্যিই যদি এটাকে সে ভঙ্গ করার দৃঢ় সংকল্প করে ফেলে তবে তার ছিয়াম বাতিল হয়ে যাবে। আর এটা রামাযান মাসে হলে দিনের অবশিষ্ট অংশ তাকে পানাহার ছাড়াই কাটাতে হবে। কেননা বিনা ওযরে যে ব্যক্তি রামাযানে ছিয়াম ভঙ্গ করবে তাকে যেমন দিনের বাকী অংশ ছিয়াম অবস্থাতেই কাটাতে হবে, অনুরূপভাবে তার কাযাও আদায় করতে হবে।

কিন্তু যদি দৃঢ় সংকল্প না করে বরং দ্বিধা-দ্বন্দে থাকে, তবে তার ব্যাপারে বিদ্বানদের মতবিরোধ রয়েছে।

কেউ বলেছেন, তার ছিয়াম বাতিল হয়ে যাবে। কেননা দ্বিধা-দ্বন্দ দৃঢ়তার বিপরীত।

কেউ বলেছেন, বাতিল হবে না। কেননা আসল হচ্ছে, নিয়তের দৃঢ়তা অবশিষ্ট থাকা, যে পর্যন্ত তা আরেকটি দৃঢ়তা দ্বারা বিচ্ছিন্ন না করবে। আমার দৃষ্টিতে এমতই বিশুদ্ধ। (আল্লাহ্‌ই অধিক জ্ঞান রাখেন)

প্রশ্নঃ (১৯) রোজাদার ভুলক্রমে পানাহার করলে তার ছিয়ামের বিধান কি? কেউ এটা দেখলে তার করণীয় কি?

উত্তরঃ রামাযানের রোযা রেখে কেউ যদি ভুলক্রমে খানা-পিনা করে তবে তার ছিয়াম বিশুদ্ধ। তবে স্মরণ হওয়ার সাথে সাথে বিরত হওয়া ওয়াজিব। এমনকি খাদ্য বা পানীয় যদি মুখের মধ্যে থাকে এবং স্মরণ হয়, তবে তা ফেলে দেয়া ওয়াজিব। ছিয়াম বিশুদ্ধ হওয়ার দলীল হচ্ছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

যে ব্যক্তি রোযা রেখে ভুলক্রমে পানাহার করে, সে যেন তার ছিয়াম পূর্ণ করে। কেননা আল্লাহ্‌ই তাকে খাইয়েছেন ও পান করিয়েছেন।[18]

তাছাড়া ভুলক্রমে নিষিদ্ধ কাজ করে ফেললে তাকে পাকড়াও করা হবে না। আল্লাহ্‌ বলেন, হে আমাদের পালনকর্তা আমরা যদি ভুলে যাই বা ভুলক্রমে কোন কিছু করে ফেলি, তবে আমাদের পাকড়াও করবেন না।(সূরা বাক্বারাঃ ২৮৬) আল্লাহ্‌ বলেন, আমি তাই করলাম।

কেউ যদি দেখতে পায় যে ভুলক্রমে কোন মানুষ খানা-পিনা করছে, তবে তার উপর ওয়াজিব হচ্ছে, তাকে বাঁধা দেয়া এবং ছিয়ামের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া। কেননা ইহা গর্হিত কাজে বাধা দেয়ার অন্তর্গত। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

যে ব্যক্তি কোন গর্হিত কাজ হতে দেখবে, সে যেন হাত দ্বারা বাধা প্রদান করে, যদি সম্ভব না হয় তবে যবান দ্বারা বাধা দিবে, যদি তাও সম্ভব না হয় তবে অন্তর দ্বারা তা ঘৃণা করবে।[19]

সন্দেহ নেই রোযা রেখে খানা-পিনা করা একটি গর্হিত কাজ। কিন্তু ভুল ক্রমে হওয়ার কারণে তাকে ক্ষমা করা হবে। কিন্তু যে ব্যক্তি তা দেখবে তার জন্য তাতে বাধা না দেয়ার কোন ওযর থাকতে পারে না।

প্রশ্নঃ (২০) রোযা রেখে সুরমা ব্যবহার করার বিধান কি?

উত্তরঃ রোযাদারের জন্য সুরমা ব্যবহার করায় কোন অসুবিধা নেই। অনুরূপভাবে চোখে বা কানে ঔষুধ (ড্রপ) ব্যবহার করতেও কোন অসুবিধা নেই, যদিও এতে গলায় ড্রপের স্বাদ অনুভব করে। এতে রোযা ভঙ্গ হবে না। কেননা ইহা খাদ্য বা পানীয় নয় বা খানা-পিনার বিকল্প হিসেবেও ব্যবহৃত নয়। একথার দলীল হচ্ছে, ছিয়ামের ক্ষেত্রে যে নিষেধাজ্ঞা তা হচ্ছে খানা-পিনা করা। সুতরাং যা খানা-পিনার অন্তর্ভূক্ত নয় তা এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে গণ্য হবে না। ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহঃ) একথাই বলেছেন। আর এটাই বিশুদ্ধ মত।

কিন্তু যদি নাকে ড্রপ ব্যবহার করে এবং তা পেটে পৌঁছে, তবে রোযা ভঙ্গ হবে- যদি রোযা ভঙ্গের উদ্দেশ্য করে থাকে। কেননা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

ছিয়াম অবস্থায় না থাকলে ওযুর ক্ষেত্রে নাকে অতিরিক্ত পানি নিবে।[20]

প্রশ্নঃ (২১) রোযা অবস্থায় মেসওয়াক ও সুগন্ধি ব্যবহার করার বিধান কি?

উত্তরঃ বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে দিনের প্রথম ভাগে যেমন শেষ ভাগেও তেমন মেসওয়াক করা সুন্নাত। কেননা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

মেসওয়াক হচ্ছে মুখের পবিত্রতা ও প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম।[21]

তিনি আরো বলেন,

আমার উম্মতের জন্য কষ্টকর মনে না করলে আমি প্রত্যেক নামাযের সময় তাদেরকে মেসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম।[22]

অনুরূপভাবে আতর-সুগন্ধি ব্যবহার করাও রোযাদারের জন্য জায়েয। চাই তা দিনের প্রথম ভাগে হোক বা শেষ ভাগে। চাই উক্ত সুগন্ধি ভাপ হোক বা তৈল জাতীয় বা সেন্ট প্রভৃতি হোক। তবে ভাপের সুগন্ধি নাকে টেনে নেয়া জায়েয নয়। কেননা ধোঁয়ার মধ্যে প্রত্যক্ষ ও অনুভবযোগ্য কিছু অংশ আছে যা নাক দ্বারা গ্রহণ করলে নাকের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করে পেটে পৌঁছায়।[23] এজন্য নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লাক্বীত বিন ছাবুরা (রাঃ)কে বলেছেন, ছিয়াম অবস্থায় না থাকলে ওযুর ক্ষেত্রে নাকে অতিরিক্ত পানি নিবে।[24]

প্রশ্নঃ (২২) ছিয়াম ভঙ্গকারী বিষয় কি কি?

উত্তরঃ ছিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়গুলো হচ্ছে নিম্নরূপঃ

ক) স্ত্রী সহবাস।

খ) খাদ্য গ্রহণ।

গ) পানীয় গ্রহণ।

ঘ) উত্তেজনার সাথে বীর্যপাত করা।

ঙ) খানা-পিনার অন্তর্ভূক্ত এমন কিছু গ্রহণ করা। যেমন সেলাইন ইত্যাদি।

চ) ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা।

ছ) শিঙ্গা লাগিয়ে রক্ত বের করা।

জ) হায়েয বা নেফাসের রক্ত প্রবাহিত হওয়া।

উল্লেখিত বিষয়গুলোর দলীল নিম্নরূপঃ

সহবাস ও খান-পিনা সম্পর্কে আল্লাহ্‌ বলেন,

এক্ষণে তোমরা (রোযার রাত্রেও) তাদের সাথে সহবাস করতে পার এবং আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য যা লিপিবদ্ধ করেছেন তা অনুসন্ধান কর। এবং প্রত্যুষে (রাতের) কাল রেখা হতে (ফজরের) সাদা রেখা প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত তোমরা খাও ও পান কর; অতঃপর রাত্রি সমাগম পর্যন্ত তোমরা রোযা পূর্ণ কর।(সূরা বাক্বারাঃ ১৮৭)

উত্তেজনার সাথে বীর্যপাত রোযা ভঙ্গের কারণ। দলীল, হাদীছে কুদসীতে আল্লাহ্‌ তা’আলা রোযাদারের উদ্দেশ্যে বলেন, সে খানা-পিনা ও উত্তেজনা পরিত্যাগ করে আমারই কারণে।[25] উত্তেজনার সাথে বীর্যপাত করার ক্ষেত্রে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

স্ত্রী সঙ্গমেও তোমাদের জন্য সাদকার ছওয়াব রয়েছে। সাহাবীগণ (আশ্চর্য হয়ে) জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহ্‌র রাসূল! আমাদের একজন তার উত্তেজনার চাহিদা মেটাবে, আর এতে ছওয়াবের হকদার হবে এটা কেমন কথা? তিনি জবাবে বললেনঃ তোমরা কি মনে কর, সে যদি এই কাজ কোন হারাম স্থানে করত তবে পাপের অধিকারী হত না? তেমনি হালাল স্থানে ব্যবহার করার কারণে অবশ্যই সে পুরস্কারের অধিকারী হবে।[26]

আর উত্তেজনার চাহিদা মেটানোর মাধ্যম হচ্ছে স্ববেগে বীর্য নির্গত হওয়া। এজন্য বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, মযী[27] বের হলে ছিয়াম বিনষ্ট হবে না, যদিও তা উত্তেজনা, চুম্বন ও স্পর্শ করার কারণে হয়।

খানা-পিনার অন্তর্ভূক্ত এমন কিছু গ্রহণ করা রোযা ভঙ্গের কারণ। যেমন, খানা-পিনার অভাব পূর্ণ করবে এরকম সেলাইন গ্রহণ করা। কেননা ইহা যদিও সরাসরি খানা-পিনা নয় কিন্তু ইহা খানা-পিনার কাজ করে এবং তার প্রয়োজন মেটায়। একারণেই তো ইহা দ্বারা শরীরের গঠন প্রকৃতি ঠিক থাকে, খানা-পিনার অভাব অনুভব করে না।

কিন্তু খানা-পিনার কাজ করে না এরকম ইন্‌জেকশন গ্রহণ করলে রোযা ভঙ্গ হবে না। চাই উহা শিরার মধ্যে প্রদান করা হোক বা পেশীতে বা শরীরের যে কোন স্থানে।

ইচ্ছাকৃত বমি করা। অর্থাৎ বমির মাধ্যমে পেটের মধ্যে যা আছে তা মুখ দিয়ে বাইরে বের করা। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করবে সে যেন রোযা কাযা আদায় করে। কিন্তু অনিচ্ছাকৃত যার বমি হয় তার কোন কাযা নেই।[28]

এর কারণ হচ্ছে, মানুষ বমি করলে তার পেট খাদ্যশুন্য হয়ে যায়। তখন তার এই শুন্যতা পূরণের প্রয়োজন পড়ে। এ কারণে আমরা বলব, ছিয়াম ফরয হলে কোন মানুষের বমি করা জায়েয নয়। কেননা বমি করলে তার ফরয ছিয়াম বিনষ্ট হয়ে যাবে। তবে অসুস্থতার কারণে অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি হলে রোযা নষ্ট হবে না।

শিঙ্গা লাগানো। অর্থাৎ শিঙ্গা লাগানোর মাধ্যমে শরীর থেকে রক্ত বের করা। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

যে ব্যক্তি শিঙ্গা লাগায় ও যার শিঙ্গা লাগানো হয় উভয়ের রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে।[29]

হায়েয বা নেফাসের রক্ত প্রবাহিত হওয়া। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নারীদের সম্পর্কে বলেন,

সে কি এমন নয় যে, ঋতুবতী হলে নামায পড়বে না ও রোযা রাখবে না।[30]

উল্লেখিত বিষয়গুলো নিম্ন লিখিত তিনটি শর্তের ভিত্তিতে রোযা ভঙ্গের কারণ হিসেবে গণ্য হবেঃ

1)          জ্ঞান থাকা।

2)          স্মরণ থাকা।

3)         ইচ্ছাকৃতভাবে করা।

প্রথম শর্তঃ জ্ঞান থাকা। অর্থাৎ উক্ত বিষয়ে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে শরীয়তের বিধান সম্পর্কে জ্ঞান থাকা অথবা ছিয়ামের জন্য যে সময় নির্দিষ্ট সে সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা।

যদি শরীয়তের বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে তবে তার ছিয়াম বিশুদ্ধ হবে। কেননা আল্লাহ্‌ বলেন,

হে আমাদের পালনকর্তা আমরা যদি ভুলে যাই বা ভুলক্রমে কোন কিছু করে ফেলি, তবে আমাদের পাকড়াও করবেন না।(সূরা বাক্বারাঃ ২৮৬)

আল্লাহ্‌ বলেন, আমি তাই করলাম। আল্লাহ্‌ আরো বলেন,

ভুলক্রমে তোমরা যা করে ফেল সে সম্পর্কে তোমাদের কোন গুনাহ্‌ নেই। কিন্তু তোমাদের অন্তর যার ইচ্ছা করে তার কথা ভিন্ন।(সূরা আহযাবঃ ৫)

সুন্নাহ্‌ থেকে ছিয়ামের ক্ষেত্রে বিশেষ দলীল হচ্ছে, ছহীহ্‌ হাদীছে আ’দী বিন হাতেম (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি রোযা রাখার উদ্দেশ্যে শেষ রাতে উট বাঁধার দুটো রশী বালিশের নীচে রেখে দিলেন। একটি কালো রঙের অন্যটির রং সাদা। এরপর খানা-পিনা করতে থাকলেন। যখন  দৃষ্টিতে সাদা ও কালো রশী চিনতে পারলেন তখন খানা-পিনা বন্ধ করলেন। সকালে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর দরবারে গিয়ে বিষয়টি উল্লেখ করলে তিনি তাকে বললেন, কুরআনের আয়াতে সাদা ও কালো সুতা বলতে আমাদের পরিচিত সূতা বা রশী উদ্দেশ্য নয়। এ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, সাদা সুতা বলতে দিনের শ্রভ্রতা (সুবহে সাদেক বা ফজর হওয়া) আর কালো সূতা বলতে রাতের অন্ধকার উদ্দেশ্য। কিন্তু নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে ছিয়াম কাযা আদায় করার আদেশ করেন নি।[31] কেননা বিষয়টি সম্পর্কে তিনি ছিলেন অজ্ঞ। ভেবেছিলেন এটাই আয়াতের অর্থ।

আর ছিয়ামের জন্য যে সময় নির্দিষ্ট সে সম্পর্কে অজ্ঞ থাকলেও তার ছিয়াম বিশুদ্ধ। দলীল: ছহীহ্‌ বুখারীতে আসমা বিনতে আবু বকর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা একদা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর যুগে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার কারণে ইফতার করে নিয়েছিলাম। তার কিছুক্ষণ পর আবার সূর্য দেখা গিয়েছিল।কিন্তু নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে উক্ত ছিয়ামের কাযা আদায় করার আদেশ করেন নি। কেননা কাযা আদায় করা ওয়াজিব হলে তিনি অবশ্যই সে আদেশ প্রদান করতেন। আর সে আদেশ থাকলে আমাদের কাছেও তার বর্ণনা পৌঁছতো। কেননা আল্লাহ্‌ বলেন,

নিশ্চয় আমি যিকির অবতীর্ণ করেছি আর আমিই তার সংরক্ষণকারী।(সূরা হিজ্‌রঃ ৯)

অতএব প্রয়োজন থাকা সত্বেও যখন এক্ষেত্রে কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না, তাই বুঝা যায় যে, তিনি তাদেরকে এর কাযা আদায় করার নির্দেশ প্রদান করেন নি। অতএব অজ্ঞতা বশতঃ দিন থাকতেই পানাহার করে ফেললে তার কাযা আদায় করা ওয়াজিব নয়। জানার সাথে সাথে পানাহার থেকে বিরত থাকবে এবং দিনের বাকী অংশ ছিয়াম অবস্থায় অতিবাহিত করবে।

অনুরূপভাবে কোন লোক যদি খানা-পিনা করে এই ভেবে যে এখনও রাত আছে- ফজর হয়নি। কিন্তু পরে জানলো যে সে ফজর হওয়ার পরই পানাহার করেছে, তবে তার ছিয়াম বিশুদ্ধ হবে। তাকে কাযা আদায় করতে হবে না। কেননা সে ছিল অজ্ঞ।

দ্বিতীয় শর্তঃ স্মরণ থাকা। অর্থাৎ সে যে রোযা রেখেছে একথা ভুলে না যাওয়া। অতএব রোযা রেখে ভুলক্রমে কোন মানুষ যদি খানা-পিনা করে ফেলে, তবে তার ছিয়াম বিশুদ্ধ এবং তাকে কাযা আদায় করতে হবে না। কেননা আল্লাহ্‌ বলেন,

হে আমাদের পালনকর্তা আমরা যদি ভুলে যাই বা ভুলক্রমে কোন কিছু করে ফেলি, তবে আমাদের পাকড়াও করবেন না।(সূরা বাক্বারাঃ ২৮৬)

আল্লাহ্‌ বলেন, আমি তাই করলাম। আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

যে ব্যক্তি রোযা রেখে ভুলক্রমে পানাহার করে, সে যেন তার ছিয়াম পূর্ণ করে। কেননা আল্লাহ্‌ই তাকে খাইয়েছেন ও পান করিয়েছেন।[32]

তৃতীয় শর্তঃ ইচ্ছাকৃত করা। অর্থাৎ রোযাদার নিজ ইচ্ছায় উক্ত রোযা ভঙ্গের কাজে লিপ্ত হবে। অনিচ্ছাকৃতভাবে হলে তার ছিয়াম বিশুদ্ধ হবে চাই তাকে জোর জবরদস্তী করা হোক বা না হোক। কেননা বাধ্য করে কুফরীকারীকে আল্লাহ্‌ বলেন,

যার উপর জবরদস্তী করা হয়েছে এবং তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে সে ব্যতীত যে কেউ বিশ্বাসী হওয়ার পর আল্লাহ্‌তে অবিশ্বাসী হয় এবং কুফরীর জন্য মন উম্মুক্ত করে দেয় তাদের উপর আপতিত হবে আল্লাহ্‌র গযব এবং তাদের জন্যে রয়েছে শাস্তি।(সূরা নাহালঃ ১০৬)

বাধ্য অবস্থায় কুফরীতে লিপ্ত হওয়ার পাপ যদি ক্ষমা করা হয়; তবে তার নিম্ন পর্যায়ের পাপে বাধ্য হয়ে লিপ্ত হলে ক্ষমা হওয়াটা অধিক যুক্তিযুক্ত। তাছাড়া হাদীছে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন,

নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তা’আলা আমার উম্মতের ভুল ক্রমে করে ফেলা এবং আবশ্যিক বিষয় করতে ভুলে যাওয়া ও বাধ্য অবস্থায় করে ফেলা পাপ ক্ষমা করে দিয়েছেন।[33]

এভিত্তিতে কারো নাকে যদি ধুলা ঢুকে পড়ে এবং তার স্বাদ গলায় পৌঁছে ও পেটের ভিতর প্রবেশ করে, তবে তার রোযা ভঙ্গ হবে না। কেননা সে এটার ইচ্ছা করেনি।

অনুরূপভাবে কাউকে যদি ইফতার করতে জবরদস্তি করা হয় আর সে বাধ্য হয়ে ইফতার করে ফেলে, তবে তার ছিয়াম বিশুদ্ধ। কেননা সে অনিচ্ছাকৃতভাবে একাজ করেছে।

এমনিভাবে ঘুমন্ত ব্যক্তির স্বপ্নদোষ হলে, তার ছিয়ামও বিশুদ্ধ। কেননা সে ছিল ঘুমন্ত, ইচ্ছাও ছিল না তার একাজে। কোন ব্যক্তি যদি স্ত্রীকে তার সাথে সহবাস করতে বাধ্য করে এবং স্ত্রী বাধ্যগত হয়ে সহবাসে লিপ্ত হয়, তবে তার (স্ত্রীর) ছিয়াম বিশুদ্ধ। কেননা একাজে তার কোন এখতিয়ার ছিল না।

একটি মাসআলাঃ খুবই সতর্ক থাকা উচিত। কোন মানুষ যদি রামাযানে দিনের বেলায় স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হয়, তবে নিম্ন লিখিত পাঁচটি বিধান তার ক্ষেত্রে প্রজোয্য হবেঃ

1)           সে গুনাহগার হবে।

2)          দিনের বাকী অংশ তাকে ছিয়াম অবস্থায় কাটাতে হবে।

3)          তার উক্ত ছিয়াম বিনষ্ট হবে।

4)          তাকে কাযা আদায় করতে হবে।

5)          কাফ্‌ফারা আদায় করতে হবে।

সহবাসে লিপ্ত হলে কি ধরণের কাফ্‌ফারা দিতে হবে এ সম্পর্কে জানা থাক বা নাজানা থাক কোন পার্থক্য নেই। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি রামাযানের দিনের বেলায় স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হল- রোযাও তার উপর ফরয-[34] কিন্তু তার এই জ্ঞান নেই যে, একাজ করলে তাকে এত কাফ্‌ফারা দিতে হবে, তবুও তার উপর উল্লেখিত বিধান সমূহ প্রজোয্য হবে। কেননা সে ইচ্ছাকৃতভাবে রোযা ভঙ্গ করেছে। আর ইচ্ছাকৃতভাবে রোযা ভঙ্গের কাজে লিপ্ত হলে, তার উপর যাবতীয় বিধান প্রজোয্য হবে। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। জনৈক ব্যক্তি নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! আমি ধ্বংস হয়ে গেছি। তিনি বললেন, কিসে তোমাকে ধ্বংস করল?সে বলল, রামাযানের রোযা রেখে আমি স্ত্রী সহবাস করে ফেলেছি। তখন নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে কাফ্‌ফারা আদায় করার আদেশ করলেন।[35] অথচ লোকটি জানতো না যে তাকে কাফ্‌ফারা দিতে হবে কি হবে না।

আমরা বলেছি, তার উপর রোযা ফরয। অর্থাৎ সে মুসাফির নয় নিজ গৃহে মুক্বীম হিসেবে অবস্থান করছে। যদি সফরে থেকে কোন ব্যক্তি রোযা ভঙ্গ করে এবং স্ত্রী সহবাস করে তবে কাফ্‌ফারা দিতে হবেনা। কেননা সফর অবস্থায় রোযা রাখা ফরয নয়। রোযা ভঙ্গ করা ও রাখার ব্যাপারে সে স্বাধীন| তবে ভঙ্গ করলে পরে কাযা আদায় করতে হবে।

 

প্রশ্নঃ (২৩) রোযা অবস্থায় শ্বাসকষ্টের কারণে স্প্রে(nabulijer) ব্যবহার করার বিধান কি? এ দ্বারা কি ছিয়াম ভঙ্গ হবে?

উত্তরঃ এই সেপ্র নাকে প্রবেশ করে কিন্তু পেট পর্যন্ত পৌঁছে না। তাই রোযা রেখে ইহা ব্যবহার করতে কোন অসুবিধা নেই। এতে রোযা ভঙ্গও হবে না। কেননা এটা এমন বস্তু যা উড়ে বেড়ায় নাকে প্রবেশ করে এবং বিলীন হয়ে যায়, এর অংশ বিশেষ পেটের মধ্যে প্রবেশ করে না। তাই এদ্বারা ছিয়াম ভঙ্গ হবে না।

প্রশ্নঃ (২৪) বমি করলে কি রোযা ভঙ্গ হবে?

উত্তরঃ কোন লোক যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করে তবে তার রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। কিন্তু অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি হলে রোযা ভঙ্গ হবেনা। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত বমি করবে সে যেন রোযা কাযা আদায় করে। কিন্তু অনিচ্ছাকৃত যার বমি হয় তার কোন কাযা নেই।[36]

কিন্তু বমি যদি আপনাকে পরাজিত করে ফেলে- বমি বের হয়েই যায়, তবে রোযা ভঙ্গ হবেনা। মানুষ যদি পেটের মধ্যে খিচুনী অনুভব করে, মনে হয় যেন ভিতর থেকে সব কিছু বের হয়ে আসবে, তখন তাতে বাধা দিবেনা। সাধারণভাবে থাকার চেষ্টা করবে। ইচ্ছা করে কোন কিছু বের করার চেষ্টা করবে না। নিজে নিজে বের হয়ে আসলে কোন ক্ষতি হবেনা এবং রোযাও নষ্ট হবেনা।

প্রশ্নঃ (২৫) রোযাদারের দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত বের হলে কি রোযা নষ্ট হবে?

উত্তরঃ দাঁত থেকে রক্ত প্রবাহিত হলে রোযার উপর কোন প্রভাব পড়বে না। কিন্তু সাধ্যানুযায়ী রক্ত গিলে নেয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকবে। অনুরূপভাবে নাক থেকে রক্ত বের হলেও রোযা নষ্ট হবে না। কিন্তু রক্ত ভিতরে যাওয়া থেকে সতর্ক থাকবে। নাক বা দাঁত থেকে রক্ত বের হওয়া রোযা ভঙ্গের কারণ নয়। অতএব কাযা আদায় করার প্রশ্নই উঠে না।

ঋতুবতী ফজরের পূর্বে পবিত্র হলে রোযা রাখবে।

প্রশ্নঃ (২৬) ঋতুবতী যদি ফজরের পূর্বে পবিত্র হয় এবং ফজর হওয়ার পর গোসল করে, তবে তার রোযার বিধান কি?

উত্তরঃ ফজরের পূর্বে পবিত্র হয়েছে এব্যাপারে নিশ্চিত হলে, তার ছিয়াম বিশুদ্ধ হবে। কেননা নারীদের মধ্যে অনেকে এমন আছে, ধারণা করে যে পবিত্র হয়ে গেছে অথচ সে আসলে পবিত্র হয়নি। এই কারণে নারীরা আয়েশা (রাঃ) এর কাছে আসতেন তাদের লজ্জাস্থানে তুলা লাগিয়ে উক্ত তুলার চিহ্ন দেখানোর জন্য যে, তারা কি পবিত্র হয়েছেন? তখন তিনি বলতেন,  ‘তোমরা তাড়াহুড়া করবে না যতক্ষণ না তোমরা কাছ্‌ছা বাইযা (বা সাদা পানি) না দেখ।’ অতএব নারী অবশ্যই ধীরস্থীরতার সাথে লক্ষ্য করবে এবং নিশ্চিত হবে পূর্ণরূপে পবিত্র হয়েছে কিনা। যদি পবিত্র হয়ে যায় তবে ছিয়ামের নিয়ত করে নিবে। ফজর হওয়ার পর গোসল করবে কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু নামাযের দিকে লক্ষ্য রেখে দ্রুত গোসল সেরে নেয়ার চেষ্টা করবে, যাতে করে সময়ের মধ্যেই ফজর নামায আদায় সম্ভব হয়।

আমরা শুনতে পাই অনেক নারী ফজরের পূর্বে বা পরে ঋতু থেকে পবিত্র হয়, কিন্তু তারা গোসল করতে দেরী করে নামাযের সময় পার করে দেয়। পরিপূর্ণ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হওয়ার যুক্তিতে সূর্য উঠার পর গোসল করে। কিন্তু এটা মারাত্মক ধরণের ভুল। চাই তা রামাযান মাসে হোক বা অন্য মাসে। কেননা তার উপর ওয়াজিব হচ্ছে সময়মত নামায আদায় করার জন্য দ্রুত গোসল সেরে নেয়া। নামাযের উদ্যেশ্যে গোসলের ওয়াজিব কাজগুলো সারলেই যথেষ্ট হবে। তারপর দিনের বেলায় আবারো যদি পরিপূর্ণরূপে অতিরিক্ত পরিচ্ছন্নতার জন্য গোসল করে, তবে কি অসুবিধা আছে?

ঋতুবতী নারীর মত অন্যান্য নাপাক ব্যক্তিগণ (যেমন স্ত্রী সহবাস বা স্বপ্ন দোষের কারণে নাপাক) নাপাক অবস্থাতেই ছিয়ামের নিয়ত করতে পারবে। এবং ফজর হওয়ার পর গোসল করে নামায আদায় করবে। কেননা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনো কখনো স্ত্রী সহবাসের কারণে নাপাক অবস্থাতেই ছিয়ামের নিয়ত করতেন এবং ফজর হওয়ার পর নামাযের আগে গোসল করতেন।[37] (আল্লাহ্‌ই অধিক জ্ঞান রাখেন।)

প্রশ্নঃ (২৭) রোযা অবস্থায় দাঁত উঠানোর বিধান কি?

উত্তরঃ সাধারণ দাঁত বা মাড়ির দাঁত উঠানোতে যে রক্ত প্রবাহিত হয়, তাতে রোযা ভঙ্গ হবে না। কেননা এতে শিঙ্গা লাগানোর মত প্রভাব পড়ে না। তাই রোযাও ভঙ্গ হবে না।

প্রশ্নঃ (২৮) রোযা রেখে রক্ত পরীক্ষা (Blood test) করার জন্য রক্ত প্রদান করার বিধান কি? এতে কি রোযা নষ্ট হবে।

উত্তরঃ ব্লাড টেষ্ট করার জন্য রক্ত বের করলে রোযা ভঙ্গ হবে না। কেননা ডাক্তার অসুস্থ ব্যক্তির চেক আপ করার জন্য রক্ত নেয়ার নির্দেশ দিতে পারে। কিন্তু এই রক্ত নেয়া অল্প হওয়ার কারণে শিঙ্গা লাগানোর মত এর কোন প্রভাব শরীরে দেখা যায় না, তাই এতে রোযা ভঙ্গ হবেনা। আসল হচ্ছে ছিয়াম ভঙ্গ না হওয়া- যতক্ষণ পর্যন্ত রোযা ভঙ্গের জন্য শরীয়ত সম্মত দলীল না পাওয়া যাবে। আর সামান্য রক্ত বের হলে রোযা ভঙ্গ হবে এখানে এমন কোন দলীল পাওয়া যায় না।

কিন্তু রোগীর শরীরে রক্ত প্রবেশ করার জন্য বেশী পরিমাণে রক্ত প্রদান করা রোযা ভঙ্গের অন্যতম কারণ। কেননা এর মাধ্যমে শিঙ্গা লাগানোর মত শরীরে প্রভাব পড়ে। অতএব ছিয়াম যদি ওয়াজিব হয়, তবে এভাবে বেশী পরিমাণে রক্ত দান করা জায়েয নয়। তবে রোগীর অবস্থা যদি আশংকা জনক হয়, মাগরিব পর্যন্ত অপেক্ষা করলে তার প্রাণ নাশের সম্ভাবনা থাকে এবং ডাক্তারদের সিদ্ধান্ত যে, এই রোযাদারের রক্তই শুধু রোগীর উপকারে আসবে ও তার প্রাণ বাঁচানো সম্ভবপর হতে পারে, তবে এই অবস্থায় রক্ত দান করতে কোন অসুবিধা নেই। রক্ত দানের মাধ্যমে রোযা ভঙ্গ করে পানাহার করবে। অতঃপর এই রোযার কাযা আদায় করবে। (আল্লাহ্‌ই অধিক জ্ঞান রাখেন।)

প্রশ্নঃ (২৯) রোযাদার হস্ত মৈথুন করলে কি রোযা ভঙ্গ হবে? তাকে কি কোন কাফ্‌ফারা দিতে হবে?

উত্তরঃ রোযাদার হস্ত মৈথুন করে যদি বীর্যপাত করে তবে তার রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। দিনের বাকী অংশ তাকে ছিয়াম অবস্থায় কাটাতে হবে। এ অপরাধের জন্য আল্লাহ্‌র কাছে তওবা করতে হবে এবং উক্ত দিনের রোযা কাযা আদায় করতে হবে। কিন্তু কাফ্‌ফারা আবশ্যক হবে না। কেননা কাফ্‌ফারা শুধুমাত্র সহবাসের মাধ্যমে রোযা ভঙ্গ করলে আবশ্যক হবে।

প্রশ্নঃ (৩০) রোযাদারের জন্য আতর-সুগন্ধির ঘ্রাণ নেয়ার বিধান কি?

উত্তরঃ রোযাদারের আতর-সুগন্ধির ঘ্রাণ নেয়াতে কোন অসুবিধা নেই। চাই তৈল জাতীয় হোক বা ধোঁয়া জাতীয়। তবে ধোঁয়ার সুঘ্রাণ নাকের কাছে নিয়ে শুঁকবে না। কেননা এতে একজাতীয় পদার্থ আছে যা পেট পর্যন্ত পৌঁছায়, তখন রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। যেমন পানি বা তদানুরূপ বস্তু। কিন্তু সাধারণ ভাবে তার সুঘ্রাণ নাকে ঢুকলে কোন অসুবিধা নেই।

প্রশ্নঃ (৩১) নাকে ধোঁয়া টানা এবং চোখে বা নাকে ড্রপ দেয়ার মধ্যে পার্থক্য কি?

উত্তরঃ উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, নাকে ভাপের ধোঁয়া টানা নিজ ইচ্ছায় হয়ে থাকে। যাতে করে ধোঁয়ার কিছু অংশ পেটে প্রবেশ করে, তাই এতে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। কিন্তু ড্রপ ব্যবহার করে উহা পেটে পৌঁছানোর ইচ্ছা করা হয় না; বরং এতে উদ্দেশ্য হচ্ছে নাকে বা চোখে শুধু ড্রপ ব্যবহার করা।

প্রশ্নঃ (৩২) রোযাদারের নাকে, কানে ও চোখে ড্রপ ব্যবহার করার বিধান কি?

উত্তরঃ নাকের ড্রপ যদি নাড়ী পর্যন্ত পৌঁছে তবে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। কেননা লাক্বীত বিন সাবুরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বলেন, ছিয়াম অবস্থায় না থাকলে ওযুর ক্ষেত্রে নাকে অতিরিক্ত পানি নিবে।[38] অতএব পেটে পৌঁছে এরকম করে রোযাদারের নাকে ড্রপ ব্যবহার করা জায়েয নয়। কিন্তু পেটে না পৌঁছলে কোন অসুবিধা নেই।

চোখে ড্রপ ব্যবহার করা সুরমা ব্যবহার করার ন্যায়। এতে রোযা নষ্ট হবে না। অনুরূপভাবে কানে ড্রপ ব্যবহারেও রোযা বিনষ্ট হবে না। কেননা এসব ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার কোন দলীল নেই। এবং যে সব ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা এসেছে এগুলো তারও অন্তর্ভূক্ত নয়। চোখ বা কান দ্বারা পানাহার করা যায় না। এগুলো শরীরের অন্যান্য চামড়ার লোমকুপের মত।

বিদ্বানগণ উল্লেখ করেছেন, কোন লোকের পায়ের তলায় যদি তরল কোন পদার্থ লাগানো হয় এবং এর স্বাদ গলায় অনুভব করে, তবে রোযার কোন ক্ষতি হবে না। কেননা উহা খানা-পিনা গ্রহণের স্থান নয়। অতএব সুরমা ব্যবহার করলে, চোখে বা কানে ড্রপ ব্যবহার করলে রোযা নষ্ট হবে না- যদিও এগুলো ব্যবহার করলে গলায় স্বাদ অনুভব করে।

অনুরূপভাবে চিকিৎসার জন্য অথবা অন্য কোন কারণে যদি কেউ তৈল ব্যবহার করে, তাতেও রোযার কোন ক্ষতি হবে না।

এমনিভাবে শ্বাস কষ্ট দূর করার জন্য যদি মুখে পাইপ লাগিয়ে অক্সিজেনের মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়াকে চলমান করা হয়, এবং তা পেটে পৌঁছে, তাতেও রোযার কোন ক্ষতি হবে না। কেননা উহা পানাহারের অন্তর্ভূক্ত নয়।

প্রশ্নঃ (৩৩) রোযা অবস্থায় স্বপ্নদোষ হলে কি ছিয়াম বিশুদ্ধ হবে?

উত্তরঃ হ্যাঁ, তার ছিয়াম বিশুদ্ধ হবে। কেননা স্বপ্নদোষ রোযা বিনষ্ট করে না। এটা তো মানুষের অনিচ্ছায় হয়ে থাকে। আর নিদ্রা অবস্থায় সংঘটিত বিষয় থেকে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে একটি সতর্কতাঃ বর্তমান যুগে অনেক মানুষ রামাযানের রাতে জেগে থাকে। কখনো আজেবাজে কর্ম এবং কথায় রাত কাটিয়ে দেয়। তারপর গভীর নিদ্রায় সমস্ত দিন অতিবাহিত করে। বরং মানুষের উচিত হচ্ছে, রোযার সময়টাকে যিকির, কুরআন তেলাওয়াত প্রভৃতি আনুগত্যপূর্ণ ও আল্লাহর নৈকট্যদানকারী কাজে অতিবাহিত করা।

প্রশ্নঃ (৩৪) রোযাদারের ঠান্ডা ব্যবহার করার বিধান কি?

উত্তরঃ ঠান্ডা-শীতল বস্তু অনুসন্ধান করা রোযাদার ব্যক্তির জন্য জায়েয, কোন অসুবিধা নেই। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রোযা রেখে গরমের কারণে বা তৃষ্ণার কারণে মাথায় পানি ঢালতেন।[39] ইবনু ওমর (রাঃ) রোযা রেখে গরমের প্রচন্ডতা অথবা পিপাসা হ্রাস করার জন্য শরীরে কাপড় ভিজিয়ে রাখতেন। কাপড়ের এই সিক্ততার কোন প্রভাব নেই। কেননা উহা এমন পানি নয়, যা নাড়ী পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।

প্রশ্নঃ (৩৫) রোযাদার কুলি করা বা নাকে পানি নেয়ার কারণে যদি পেটে পৌঁছে যায়, তবে কি তার রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে?

উত্তরঃ রোযাদার কুলি করা বা নাকে পানি নেয়ার কারণে যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে পানি পেটে পৌঁছে যায়, তবে তার রোযা ভঙ্গ হবে না। কেননা এতে তার কোন ইচ্ছা ছিল না। আল্লাহ্‌ বলেন,

ভুলক্রমে তোমরা যা করে ফেল সে সম্পর্কে তোমাদের কোন গুনাহ্‌ নেই। কিন্তু তোমাদের অন্তর যার ইচ্ছা করে তার কথা ভিন্ন।(সূরা আহযাবঃ ৫)

প্রশ্নঃ (৩৬) নাক থেকে রক্ত বের হলে কি রোযা নষ্ট হবে?

উত্তরঃ নাক থেকে রক্ত বের হলে রোযা নষ্ট হবে না- যদিও বেশী পরিমাণে বের হয়। কেননা এখানে ব্যক্তির কোন ইচ্ছা থাকেনা।

সতর্কতা বশতঃ ফজরের দশ/পনর মিনিট পূর্বে পানাহার বন্ধ করা।

প্রশ্নঃ (৩৭) রামাযানের কোন কোন ক্যালেন্ডারে দেখা যায় সাহুরের জন্য শেষ টাইম নির্ধারণ করা হয়েছে এবং তার প্রায় দশ/পনর মিনিট পর ফজরের টাইম নির্ধারণ করা হয়েছে। সুন্নাতে কি এর পক্ষে কোন দলীল আছে নাকি এটা বিদআত?

উত্তরঃ নিঃসন্দেহে ইহা বিদআত। সুন্নাতে নববীতে এর কোন প্রমাণ নেই। কেননা আল্লাহ্‌ তা’আলা সম্মানিত কিতাবে বলেন,

এবং প্রত্যুষে (রাতের) কাল রেখা হতে (ফজরের) সাদা রেখা প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত তোমরা খাও ও পান কর; অতঃপর রাত্রি সমাগম পর্যন্ত তোমরা রোযা পূর্ণ কর।(সূরা বাক্বারাঃ ১৮৭)

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

নিশ্চয় বেলাল রাত থাকতে আযান দেয়, তখন তোমরা খাও ও পান কর, যতক্ষণ না ইবনে উম্মে মাকতূমের আযান শোন। কেননা ফজর উদিত না হলে সে আযান দেয় না।[40]

ফজর না হতেই খানা-পিনা বন্ধ করার জন্য লোকেরা সময় নির্ধারণ করে যে ক্যালেন্ডার তৈরী করেছে তা নিঃসন্দেহে আল্লাহ্‌র নির্ধারিত ফরযের উপর বাড়াবাড়ী। আর এটা হচ্ছে আল্লাহ্‌র দ্বীনের মাঝে অতিরঞ্জন। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

অতিরঞ্জনকারীগণ ধ্বংস হোক। অতিরঞ্জনকারীগণ ধ্বংস হোক। অতিরঞ্জনকারীগণ ধ্বংস হোক।[41]

প্রশ্নঃ (৩৮) এয়ারপোর্টে থাকাবস্থায় সূর্য অস্ত গেছে মুআয্‌যিন আযান দিয়েছে, ইফতারও করে নিয়েছে। কিন্তু বিমানে চড়ে উপরে গিয়ে সূর্য দেখতে পেল। এখন কি পানাহার বন্ধ করতে হবে?

উত্তরঃ খানা-পিনা বন্ধ করা অবশ্যক নয়। কেননা যমীনে থাকাবস্থায় ইফতারের সময় হয়ে গেছে সূর্যও ডুবে গেছে। সুতরাং ইফতার করতে বাধা কোথায়? রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

এদিক থেকে যখন রাত আগমণ করবে এবং ঐদিক থেকে দিন শেষ হয়ে যাবে ও সূর্য অস্ত যাবে, তখন রোযাদার ইফতার করে ফেলবে।[42]

অতএব এয়ারপোর্টের যমীনে থাকাবস্থায় যখন সূর্য ডুবে গেছে, তখন তার দিনও শেষ হয়ে গেছে, তাই সে শরীয়তের দলীল মোতাবেক ইফতারও করে নিয়েছে। সুতরাং শরীয়তের দলীল ব্যতীরেকে আবার তাকে পানাহার বন্ধ করার আদেশ দেয়া যাবে না।

প্রশ্নঃ (৩৯) রোযাদারের কফ অথবা থুথু গিলে ফেলার বিধান কি?

উত্তরঃ কফ বা শ্লেষা যদি মুখে এসে একত্রিত না হয় গলা থেকেই ভিতরে চলে যায় তবে তার রোযা নষ্ট হবে না। কিন্তু যদি গিলে ফেলে তবে সে ক্ষেত্রে বিদ্বানদের দু’টি মত রয়েছেঃ

১ম মতঃ তার রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। কেননা উহা পানাহারের স্থলাভিষিক্ত।

২য় মতঃ রোযা নষ্ট হবে না। কেননা উহা মুখের সাধারণ থুথুর অন্তর্গত। মুখের মধ্যে সাধারণ পানি যাকে থুথু বলা হয় তা দ্বারা রোযা নষ্ট হয় না। এমনকি যদি থুথু মুখের মধ্যে একত্রিত করে গিলে ফেলে তাতেও ছিয়ামের কোন ক্ষতি হবে না।

আমরা জানি আলেমগণ মতবিরোধ করলে তার সমাধান কুরআন-সুন্নাহ্‌ থেকে খুঁজতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাতে সুস্পষ্ট কোন উক্তি নেই। এ বিষয়ে যখন সন্দেহ হয়ে গেল, তার ইবাদতটি নষ্ট হয়ে গেল না নষ্ট হল না। তখন আমাদেরকে মূলের দিকে ফিরে যেতে হবে। মূল হচ্ছে দলীল ছাড়া ইবাদত বিনষ্ট না হওয়া। অতএব কফ গিলে নিলে রোযা নষ্ট হবে না।

মোটকথা কফ নিজ অবস্থায় ছেড়ে দিবে। উহা গলার নীচে থেকে মুখে টেনে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে না। কিন্তু মুখে এসে পড়লে বাইরে ফেলে দিবে। চাই রোযাদার হোক বা না হোক। কিন্তু গিলে ফেললে রোযা নষ্ট হবে এর জন্য দলীল দরকার।

প্রশ্নঃ (৪০) খাদ্যের স্বাদ গ্রহণ করলে কি ছিয়াম নষ্ট হবে?

উত্তরঃ খাদ্যের স্বাদ গ্রহণ করে যদি তা গিলে না ফেলে, তবে ছিয়াম নষ্ট হবে না। কিন্তু একান্ত দরকার না পড়লে এরূপ করা উচিত নয়। এ অবস্থায় অনিচ্ছাকৃত যদি পেটে কিছু ঢুকে পড়ে তবে ছিয়ামের কোন ক্ষতি হবে না।

প্রশ্নঃ (৪১) রোযা রেখে হারাম বা অশ্লীল কথাবার্তা উচ্চারণ করলে কি ছিয়াম নষ্ট হবে?

উত্তরঃ আমরা আল্লাহ্‌ তা’আলার নিম্ন লিখিত আয়াত পাঠ করলেই জানতে পারি ছিয়াম ফরয হওয়ার হিকমত কি? আর তা হচ্ছে তাক্বওয়া বা আল্লাহ্‌ ভীতি অর্জন করা ও আল্লাহ্‌র ইবাদত করা। আল্লাহ্‌ বলেন,

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর ছিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে করে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার।(সূরা বাক্বারাঃ ১৮৩)

তাক্বওয়া হচ্ছে হারাম কাজ পরিত্যাগ করা। ব্যাপক অর্থে তাক্বওয়া হচ্ছে, আল্লাহ্‌র নির্দেশিত বিষয় বাস্তাবায়ন করা, তাঁর নিষেধ থেকে দূরে থাকা। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

যে ব্যক্তি (রোযা রেখে) মিথ্যা কথা, মিথ্যা অভ্যাস ও মূর্খতা পরিত্যাগ করল না, তার পানাহার পরিহার করার মাঝে আল্লাহর কোন দরকার নেই।[43]

অতএব এ কথা নিশ্চিত হয়ে গেল যে, রোযাদার যাবতীয় ওয়াজিব বিষয় বাস্তবায়ন করবে এবং সবধরণের হারাম থেকে দূরে থাকবে। মানুষের গীবত করবে না, মিথ্যা বলবে না, চুগলখোরী করবে না, হারাম বেচা-কেনা করবে না, ধোঁকাবাজী করবে না। মোটকথা চরিত্র ধ্বংসকারী অন্যায় ও অশ্লীলতা বলতে যা বুঝায় সকল প্রকার হারাম থেকে বিরত থাকবে। আর একমাস এভাবে চলতে পারলে বছরের অবশিষ্ট সময় সঠিক পথে পরিচালিত হবে ইনশাআল্লাহ্‌।

কিন্তু আফসোসের বিষয় অধিকাংশ রোযাদার রামাযানের সাথে অন্য মাসের কোন পার্থক্য করে না। অভ্যাস অনুযায়ী ফরয কাজে উদাসীনতা প্রদর্শন করে, হালাল-হারামে কোন পার্থক্য নেই। গর্হিত ও অশ্লীল কথা কাজে লিপ্ত থাকে। মিথ্যা, ধোঁকাবাজী প্রভৃতি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তাকে দেখলে বুঝা যাবে না তার মধ্যে ছিয়ামের মর্যাদার কোন মূল্য আছে। অবশ্য এ সমস্ত বিষয় ছিয়ামকে ভঙ্গ করে দিবে না। কিন্তু নিঃসন্দেহে তার ছওয়াব বিনষ্ট করে দিবে।

 

প্রশ্নঃ (৪২) মিথ্যা স্বাক্ষ্য দেয়ার বিধান কি? ইহা কি ছিয়াম নষ্ট করে?

উত্তরঃ মিথ্যা দেয়া অন্যতম কাবীরা গুনাহ্‌। আর তা হচ্ছে না জেনে কোন বিষয়ে স্বাক্ষ্য দেয়া অথবা জেনে শুনে বাস্তবতার বিপরীত সাক্ষ্য প্রদান করা। এতে ছিয়াম বিনষ্ট হবে না। কিন্তু ছিয়ামের ছওয়াব কমিয়ে দিবে।

 

প্রশ্নঃ (৪৩) ছিয়ামের আদব কি কি?

উত্তরঃ ছিয়ামের গুরুত্বপূর্ণ আদব হচ্ছে, আল্লাহ্‌ভীতি অর্জন করা তথা আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়ন ও নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকা। কেননা আল্লাহ্‌ বলেন,

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর ছিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে করে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার।(সূরা বাক্বারাঃ ১৮৩)

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

যে ব্যক্তি (রোযা রেখে) মিথ্যা কথা, মিথ্যা কাজ-কারবার ও মূর্খতা পরিত্যাগ করল না, তার পানাহার পরিহার করার মাঝে আল্লাহর কোন দরকার নেই।[44]

ছিয়ামের আরো আদব হচ্ছে, বেশী বেশী দান-খায়রাত করা, নেককাজ ও জনকল্যাণ মূলক কাজ বাস্তবায়ন করা। রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন সর্বাধিক দানশীল ব্যক্তি। রামাযান মাসে যখন জিবরীল (আঃ) তাঁকে কুরআন শিক্ষা দিতেন তখন তিনি আরো বেশী দান করতেন।[45]

আরো আদব হচ্ছে, আল্লাহ্‌ যা হারাম করেছেন তা থেকে দূরে থাকা। যাবতীয় মিথ্যাচার, গালিগালাজ, ধোকা, খিয়ানত, হারাম অশ্লীল বস্তু দেখা বা শোনা প্রভৃতি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা প্রতিটি মানুষের উপর ওয়াজিব। বিশেষ করে রোযাদারের জন্য তো অবশ্যই।

রোযার আদব হচ্ছে, সাহুর খাওয়া। এবং তা দেরী করে খাওয়া। কেননা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা সাহুর খাও। কেননা সাহুরে রয়েছে বরকত।[46]

ছিয়ামের আদব হচ্ছে, দ্রুত ইফতার করা। সূর্য অস্ত যাওয়া নিশ্চিত হলে বা অস্ত যাওয়ার অনুমান প্রবল হলেই সাথে সাথে দেরী না করে ইফতার করা। কেননা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, মানুষ কল্যাণের মাঝে থাকবে, যতদিন তারা দ্রুত ইফতার করবে।[47]

ইফতারের আদব হচ্ছে, কাঁচা খেজুর দিয়ে ইফতার করা, সম্ভব না হলে যে কোন খেজুর দ্বারা। খেজুর না পেলে পানি দ্বারাই ইফতার করবে।

প্রশ্নঃ (৪৪) ইফতারের জন্য কোন দু’আ কি প্রমাণিত আছে? রোযাদার কি মুআয্‌যিনের জবাব দিবে নাকি ইফতার চালিয়ে যাবে?

উত্তরঃ দু’আ কবূল হওয়ার অন্যতম সময় হচ্ছে ইফতারের সময়। কেননা সময়টি হচ্ছে ইবাদতের শেষ মূহুর্ত। তাছাড়া মানুষ সাধারণতঃ ইফতারের সময় অধিক দুর্বল হয়ে পড়ে। আর মানুষ যত দুর্বল হয় তার অন্তর তত নরম ও বিনয়ী হয়। তখন দু’আ করলে মনোযোগ আসে বেশী এবং আল্লাহ্‌র দিকে অন্তর ধাবিত হয়।

ইফতারের সময় দু’আ হচ্ছেঃ হে আল্লাহ্‌ আপনার জন্য রোযা রেখেছি এবং আপনার রিযিক দ্বারা ইফতার করছি।[48]

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইফতারের সময় এই দু’আ পাঠ করতেনঃ  তৃষ্ণা বিদূরিত হয়েছে, শিরা-উপশিরা তরতাজা হয়েছে এবং আল্লাহ্‌ চাহে তো প্রতিদান সুনিশ্চিত হয়েছে।[49] হাদীছ দু’টিতে যদিও দুর্বলতা রয়েছে কিন্তু কোন কোন বিদ্বান উহাকে হাসান বলেছেন। মোটকথা এগুলো দু’আ বা অন্য কোন দু’আ পাঠ করবে। ইফতারের সময় হচ্ছে দু’আ কবূল হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মূহুর্ত। কেননা হাদীছে এরশাদ হয়েছে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ছিয়াম পালনকারীর ইফতারের সময়কার দু’আ প্রত্যাখ্যান করা হয় না।[50]

আর ইফতারের সময় মুআয্‌যিনের জবাব দেয়া শরীয়ত সম্মত। কেননা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, মুআয্‌যিনের আযান শুনলে তার জবাবে সে যা বলে তোমরাও তার অনুরূপ বল।[51] এ হাদীছটি প্রত্যেক অবস্থাকে শামিল করে। তবে দলীলের ভিত্তিতে কোন অবস্থা ব্যতিক্রম হলে ভিন্ন কথা।

প্রশ্নঃ (৪৫) ছিয়াম কাযা থাকলে শাওয়ালের ছয়টি রোযা রাখার বিধান কি?

উত্তরঃ নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

যে ব্যক্তি রামাযানের রোযা রাখার পর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোযা রাখবে, সে সারা বছর রোযা রাখার প্রতিদান লাভ করবে।[52]

কোন মানুষের যদি রোযা কাযা থাকে আর সে শাওয়ালের ছয়টি রোযা রাখে, সে কি রামাযানের পূর্বে রোযা রাখল না রামাযানের পর।

উদাহরণঃ জনৈক লোক রামাযানের ২৪টি রোযা রাখল। বাকী রইল ছয়টি। এখন সে যদি কাযা আদায় না করেই শাওয়ালের ছয়টি রোযা রাখে, তাকে কি বলা যাবে সে রামাযানের রোযা পূর্ণ করার পর শাওয়ালের ছয়টি রোযা রাখল? কেননা সে তো রামাযানের রোযা পূর্ণই করেনি। অতএব রামাযানের রোযা কাযা থাকলে শাওয়ালের ছয় রোযার প্রতিদান তার জন্য প্রমাণিত হবে না।

অবশ্য আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে, কারো রোযা কাযা থাকলে তার জন্য নফল রোযা জায়েয কি না? কিন্তু আমাদের এই মাসআলাটি এই মতবিরোধের অন্তর্ভূক্ত নয়। কেননা শাওয়ালের ছয়টি রোযা রামাযানের সাথে সম্পর্কিত। যে ব্যক্তি রামাযানের রোযা পূর্ণ করেনি তার জন্য উক্ত ছয় রোযার ছওয়াব সাব্যস্ত হবেনা।

কাযা রোযা বাকী রেখে মৃত্যু বরণ করলে তার বিধান।

প্রশ্নঃ (৪৬) জনৈক অসুস্থ ব্যক্তি রামাযানে রোযা কাযা করেছে। কিন্তু পরবর্তী মাস শুরু হওয়ার চারদিনের মাথায় তার মৃত্যু হয়। তার পক্ষ থেকে কি কাযা রোযাগুলো আদায় করতে হবে?

উত্তরঃ তার এই অসুখ যদি চলতেই থাকে সুস্থ না হয় এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যু বরণ করে তবে তার পক্ষ থেকে কাযা আদায় করতে হবেনা। কেননা আল্লাহ্‌ বলেন,

আর যে লোক অসুস্থ অথবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করে নিবে।(সূরা বাক্বারাঃ ১৮৫) অতএব অসুস্থ ব্যক্তির উপর ওয়াজিব হচ্ছে, সুস্থ হলেই কাযা রোযাগুলো দ্রুত আদায় করে নেয়া।

কিন্তু রোযা রাখতে সমর্থ হওয়ার পূর্বেই যদি মৃত্যু বরণ করে, তবে রোযার আবশ্যকতা রহিত হয়ে যাবে। কেননা সে তো এমন কোন সময় পায়নি যাতে সে রোযাগুলো কাযা আদায় করতে পারে। যেমন একজন লোক রামাযান আসার পূর্বেই শাবানে মৃত্যু বরণ করল। অতএব রামাযানের রোযা রাখা তার জন্য আবশ্যক নয়। কিন্তু অসুস্থতা যদি এমন হয় যা সুস্থ হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, তবে তার পক্ষ থেকে প্রতিদিনের বিনিময়ে একজন করে মিসকীনকে খাদ্য দান করবে।

 

প্রশ্নঃ (৪৭) রামাযানের রোযা বাকী থাকাবস্থায় পরবর্তী রামাযান এসে গেলে কি করবে?

উত্তরঃ একথা সবার জানা যে, আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেছেন,

কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ অথবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করে নিবে।(সূরা বাক্বারাঃ ১৮৫)

অতএব এ লোকটি যখন শরীয়ত সম্মত দলীলের ভিত্তিতে রোযা ভঙ্গ করেছে, তখন আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নার্থে তা কাযা আদায় করা উচিত। পরবর্তী রামাযান আসার পূবেই উহা কাযা আদায় করা তার উপর ওয়াজিব। কেননা আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘আমার রামাযানের কিছু রোযা বাকী রয়ে যেত। কিন্তু শাবান মাস না আসলে আমি উহা কাযা আদায় করতে পারতাম না।’[53] আর তার কারণ ছিল রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সাথে তাঁর ব্যস্ততা। সুতরাং আয়েশা (রাঃ)এর উক্ত বাণী থেকে প্রমাণিত হয় যে, পরবর্তী রামাযান আসার পূর্বে উহা অবশ্যই কাযা আদায় করতে হবে।

কিন্তু সে যদি পরবর্তী রামাযান পর্যন্ত দেরী করে এবং রোযাটি রয়েই যায়, তবে তার উপর আবশ্যক হচ্ছে, আল্লাহ্‌র কাছে তওবা ইস্তেগফার করা, এই শীথিলতার জন্য লজ্জিত অনুতপ্ত হওয়া এবং যত দ্রুত সম্ভব তা কাযা আদায় করে নেয়া। কেননা দেরী করলে কাযা আদায় করার আবশ্যকতা রহিত হয়ে যায় না।

 

প্রশ্নঃ (৪৮) শাওয়ালের ছয়টি রোযা পালন করার ক্ষেত্রে উত্তম পদ্ধতি কি?

উত্তরঃ শাওয়ালের ছয়টি রোযা পালন করার ক্ষেত্রে উত্তম পদ্ধতি হচ্ছে, ঈদের পর পরই উহা আদায় করা এবং পরস্পর আদায় করা। বিদ্বানগণ এভাবেই বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। কেননা এতে রামাযানের অনুসরণ বাস্তবায়ন হয়। হাদীছে বলা হয়েছে যে ব্যক্তি রামাযানের পরে পরে শাওয়ালের ছয়টি রোযা রাখে..।তাছাড়া এতে নেক কাজ সম্পাদনে তাড়াহুড়া করা হল, যে ব্যাপারে প্রতিযোগিতা করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া এতে বান্দার দৃঢ়তার প্রমাণ রয়েছে। দৃঢ়তা মানুষের পরিপূর্ণতার লক্ষণ। সচেতন বান্দা সুযোগ হাতছাড়া করে না। কেননা মানুষ জানে না পরবর্তীতে কি তার জন্য অপেক্ষা করছে। অতএব বান্দা কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে চাইলে তাকে প্রতিটি নেক কর্মের দিকে দ্রুত অগ্রসর হতে হবে সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে হবে।

 

প্রশ্নঃ (৪৯) শাওয়ালের ছয়টি রোযা রাখার জন্য কি ইচ্ছামত দিন নির্ধারণ করা জায়েয? নাকি তার জন্য কোন সময় নির্দিষ্ট করা আছে? এ দিনগুলো রোযা রাখলে কি উহা ফরযের মত হয়ে যাবে এবং প্রতি বছর আবশ্যিকভাবে রোযা পালন করতে হবে?

উত্তরঃ নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে ছহীহ্‌ সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে তিনি বলেন,

যে ব্যক্তি রামাযানের রোযা রাখার পর শওয়াল মাসে ছয়টি রোযা রাখবে, সে সারা বছর রোযা রাখার প্রতিদান লাভ করবে।[54]

এ ছয়টি রোযার জন্য কোন দিন নির্দিষ্ট করা নেই। মাসের যে কোন সময় রোযাগুলো রাখা যায়। চাই মাসের প্রথম দিকে হোক বা মধ্যখানে বা শেষের দিকে। লাগাতার হোক বা ভেঙ্গে ভেঙ্গে হোক- সবই জায়েয। বিষয়টি প্রশস্ত- সুযোগ সম্পন্ন (আল্‌ হামদুল্লিাহ্‌)। তবে রামাযান শেষ হওয়ার পর পরই মাসের প্রথম দিকে দ্রুত করে নেয়া বেশী উত্তম। কেননা এতে নেক কাজে প্রতিযোগিতা করা হল, যা কাম্য।

কোন বছর এ ছিয়াম পালন করবে কোন বছর করবে না তাতে কোন অসুবিধা নেই। কেননা এ ছিয়াম নফল ফরয নয়।

প্রশ্নঃ (৫০) আশুরা ছিয়ামের বিধান কি?

উত্তরঃ নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরত করে মদীনা আগমণ করে দেখেন ইহুদীরা মুহার্‌রামের দশ তারিখে রোযা পালন করছে। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ

আমরা মূসার অনুসরণ করার ব্যাপারে তোমাদের চাইতে অধিক হকদার। তিনি নিজে সে দিনের রোযা রাখলেন এবং ছাহাবীদেরকেও নির্দেশ দিলেন।[55]

বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত ইবনু আব্বাসের হাদীছে বলা হয়েছে, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আশুরা দিবসে রোযা রেখেছেন এবং ছাহাবীদেরকে রোযা রাখার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন। এ রোযার ফযীলত সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,  আল্লাহ্‌র কাছে আশা করি তিনি বিগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।[56] কিন্তু ইহুদীদের বিরোধীতা করার জন্য তিনি এর একদিন পূর্বে ৯ তারিখ অথবা এক দিন পরে ১১ তারিখ রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

সুতরাং আশুরার রোযার ক্ষেত্রে উত্তম হচ্ছে, মুহার্‌রমের দশ তারিখের সাথে ৯ তারিখ অথবা ১১ তারিখের রোযা রাখা। অবশ্য ১১ তারিখের চেয়ে ৯ তারিখ রোযা রাখা অধিক উত্তম।

 

প্রশ্নঃ (৫১) শাবান মাসে রোযা রাখার বিধান কি?

উত্তরঃ শাবান মাসে রোযা রাখা এবং অধিক হারে রাখা সুন্নাত। আয়েশা (রাঃ) বলেন, শাবান মাস ছাড়া অন্য কোন সময় আমি নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে এত বেশী রোযা রাখতে দেখিনি।[57] এ হাদীছ অনুযায়ী শাবান মাসে অধিকহারে রোযা রাখা উচিত।

বিদ্বানগণ বলেন, শাবান মাসে রোযা রাখা সুন্নাতে মুআক্কাদা নামাযের অনুরূপ। এই রোযা যেন রামাযান মাসের ভুমিকা। অর্থাৎ রামাযানের পূর্বের সুন্নাত রোযা। অনুরূপভাবে শাওয়ালের রোযা রামাযানের পরের সুন্নাত ¯^iƒc| যেমন ফরয নামাযের আগে ও পরে সুন্নাত রয়েছে।

তাছাড়া শাবান মাসে রোযার উপকারিতা হচ্ছে, নিজেকে রামাযানের রোযা রাখার ব্যাপারে প্রস্তুত করা, রোযায় অভ্যস্ত করে তোলা। যাতে করে ফরয রোযা রাখা তার জন্য সহজসাধ্য হয়।[58]

 

প্রশ্নঃ (৫২) যার অভ্যাস আছে একদিন রোযা রাখা ও একদিন ছাড়া। সে কি শুক্রবারেও রোযা রাখতে পারে?

উত্তরঃ হ্যাঁ। কোন মানুষ যদি এক দিন পর পর রোযা রাখার অভ্যাস করে থাকে এবং তার রোযার দিন শুক্রবার হয় বা শনিবার বা রোববার হয়, তবে কোন অসুবিধা নেই। তবে সে দিন যেন এমন না হয় যখন রোযা রাখা হারাম। যেমন দু’ঈদের দিন, আইয়্যামে তাশরীকের দিন (কুরবানী ঈদের পরের তিন দিনকে আইয়্যামে তাশরীক বলা হয়)। তখন রোযা পরিত্যাগ করা ওয়াজিব। নারীদের ক্ষেত্রে ঋতু বা নেফাসের দিনগুলো রোযা রাখা হারাম।

 

প্রশ্নঃ (৫৩) ছওমে বিছাল কাকে বলে? এটা কি শরীয়ত সম্মত?

উত্তরঃ ছওমে বিসাল বা অবিচ্ছিন্ন ছিয়াম হচ্ছে, ইফতার না করে দু’দিন একাধারে রোযা রাখা। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরকম রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। আর বলেছেন, কেউ যদি অবিচ্ছিন্ন করতে চায়, তবে শেষ রাতে সাহুরের সময় পর্যন্ত মিলিত করতে পারে।[59] সাহুর পর্যন্ত রোযাকে অবিচ্ছিন্ন করণ জায়েয, সুন্নাত নয়; কোন ফযীলতপূর্ণ কাজও নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করাকে কল্যাণের কাজ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,

মানুষ ততদিন কল্যাণের মাঝে থাকবে, যতদিন তারা দ্রুত ইফতার করবে।[60]

কিন্তু সাহুরের সময় পর্যন্ত রোযাকে চালিয়ে যাওয়া বৈধ করেছেন। লোকেরা যখন বলল, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! আপনি তো ইফতার না করেই রোযা চালিয়ে যান? তিনি বললেন, আমার অবস্থা তোমাদের মত নয়, আমাকে আমার পালনকর্তা খাওয়ান ও পান করান।[61]

প্রশ্নঃ (৫৪) বিশেষভাবে জুমআর দিবস রোযা নিষেধ। এর কারণ কি? কাযা ছিয়ামও কি এদিন রাখা নিষেধ?

উত্তরঃ নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে ছহীহ্‌ সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেন, এককভাবে শুধুমাত্র শুক্রবারের দিনে রোযা রাখবে না এবং রাতে ক্বিয়াম করবে না।[62] রোযা রাখার জন্য এককভাবে এ দিনকে বেছে নেয়া নিষেধের হিকমত হচ্ছে, জুমআর দিন সপ্তাহিক ঈদের দিন। জুমআ ইসলামের তৃতীয় ঈদ হিসেবে গণ্য। প্রথম ঈদ হচ্ছে রামাযান শেষে ঈদুল ফিতর। দ্বিতীয়টি কুরবানীর ঈদ। আর তৃতীয়টি হচ্ছে, সাপ্তাহিক ঈদ জুমআর দিন।[63] একারণেই আলাদাভাবে এদিনে রোযা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে।

তাছাড়া এদিনে পুরুষদের জন্য উচিত হচ্ছে আগেভাগে জুমআর নামাযে যাওয়া, দু’আ যিকির ও কুরআন তেলাওয়াতে মাশগুল হওয়া। এদিনটি আরাফার দিবসের অনুরূপ। আরাফার দিবসে হাজীগণ রোযা রাখবেন না। কেননা এদিন তিনি দু’আ ও যিকিরে মাশগুল থাকবেন। একটি মূলনীতি হচ্ছে: কয়েকটি ইবাদত যদি একত্রিত হয়, তখন যেটা পিছানো সম্ভব হবে না সেটা তাৎক্ষণিক আদায় করবে এবং যেটি পিছানো সম্ভব হবে তা পিছিয়ে দিয়ে পরে আদায় করবে।

যদি প্রশ্ন করা হয় যে, জুমআর দিন সাপ্তাহিক ঈদের দিন হওয়ার কারণে যদি রোযা রাখা নিষেধ হয়ে থাকে, তবে তো অপর দু’টি ঈদের মত এদিনে অন্যান্য রোযা রাখাও হারাম হয়ে যায়?

উত্তরে আমরা বলবঃ এদিনটির বিধান অন্য দু’ঈদের চেয়ে ভিন্ন। কেননা ইহা প্রতি মাসে চারবার আগমণ করে। একারণে এদিনে রোযা রাখার নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণরূপে হারাম নয়। তাছাড়া দু’ঈদের মাঝে আরো বিশেষ যে বৈশিষ্ট রয়েছে তা জুমআর দিনে নেই।

কিন্তু যদি জুমআর পূর্বে একদিন ও পরে একদিন রোযা পালন করে, তখন বুঝা যাবে যে, এককভাবে জুমআর দিবস রোযা পালন করার উদ্দেশ্য ছিল না। আর এটা জায়েয।[64]

এককভাবে জুমআর দিনে রোযা রাখার নিষেধাজ্ঞা নফল এবং কাযা উভয়ের ক্ষেত্রে প্রজোয্য। কেননা হাদীছের নিষেধাজ্ঞা থেকে সাধারণভাবে একথাই বুঝা যায়। তবে যদি কোন মানুষ এরকম ব্যস্ত থাকে যে, তার কাযা ছিয়াম জুমআর দিবস ছাড়া অন্য সময় আদায় করা সম্ভব নয়, তখন তার জন্য এককভাবে সে দিন রোযা পালন করা মাকরূহ নয়। কেননা তার ওযর রয়েছে।

প্রশ্নঃ (৫৫) কোন মানুষ যদি নফল ছিয়াম ইচ্ছাকৃত ভঙ্গ করে ফেলে, তবে কি গুনাহগার হবে? যদি সহবাসের মাধ্যমে ভঙ্গ করে, তবে কি কাফ্‌ফারা দিতে হবে?

উত্তরঃ কোন মানুষ নফল রোযা রেখে যদি পানাহার বা স্ত্রী সহবাসের মাধ্যমে ভঙ্গ করে ফেলে, তবে কোন গুনাহ্‌ নেই। নফল রোযা শুরু করলেই তা পূর্ণ করা আবশ্যক নয়। তবে হজ্জ-ওমরার কাফ্‌ফারার রোযা পূর্ণ করতে হবে। কিন্তু নফল ছিয়াম শুরু করার পর পূর্ণ করাই উত্তম। তাই নফল ছিয়াম রেখে স্ত্রী সহবাসের মাধ্যমে ভঙ্গ করলে কাফ্‌ফারা দিতে হবে না। কেননা তা পূর্ণ করা আবশ্যক নয়।

কিন্তু ছিয়াম যদি ফরয হয় এবং স্ত্রী সহবাস করে তবে তা নাজায়েয। কেননা বিশেষ প্রয়োজন না দেখা দিলে ফরয ছিয়াম ভঙ্গ করা জায়েয নয়। তবে রামাযানের রোযা যদি তার উপর ফরয থাকে এবং দিনের বেলা স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হয়, তবে কাফ্‌ফারা দিতে হবে। রামাযানের রোযা যদি তার উপর ফরয থাকেএকথার অর্থ হচ্ছে: যদি স্বামী-স্ত্রী দু’জনই সফরে থাকে, দু’জনেই রোযা রাখে, তারপর সহবাসের মাধ্যমে রোযা ভঙ্গ করে, তবে তারা গুনাহগার হবে না। তাদেরকে কাফ্‌ফারা দিতে হবেনা। অবশ্য তাদেরকে উক্ত দিনের ছিয়াম কাযা আদায় করতে হবে।

প্রশ্নঃ (৫৬) এতেকাফ এবং এতেকাফকারীর বিধান কি?

উত্তরঃ এতেকাফ হচ্ছে নিঃসঙ্গ অবস্থায় আল্লাহ্‌র আনুগত্য করার জন্য মসজিদে অবস্থান করা। লায়লাতুল কদর অনুসন্ধান করার জন্য এতেকাফ করা সুন্নাত। আল্লাহ্‌ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এদিকে ইঙ্গিত করে এরশাদ করেন,

মসজিদে এতেকাফ করা অবস্থায় তোমরা স্ত্রীদের সাথে সহবাস করো না।(সূরা বাক্বারাঃ ১৮৭)

ছহীহ্‌ বুখারীতে প্রমাণিত আছে, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এতেকাফ করেছেন, তাঁর সাথে ছাহাবায়ে কেরামও এতেকাফ করেছেন।[65] এতেকাফের এই বিধান শরীয়ত সম্মত। তা রহিত হয়ে যায়নি। ছহীহ্‌ বুখারী ও মুসলিমে আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযানের শেষ দশকে এতেকাফ করেছেন, এমনকি আল্লাহ্‌ তাকে মৃত্যু দান করেছেন। মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীরা এতেকাফ করেছেন।[66]

ছহীহ্‌ মুসলিমে আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযানের প্রথম দশকে এতেকাফ করেছেন। তারপর দ্বিতীয় দশকে এতেকাফ করেছেন। অতঃপর বলেন,

নিশ্চয় আমি রামাযানের প্রথম দশকে এতেকাফ করে এই রাত্রি (লায়লাতুল কদর) অনুসন্ধান করেছি। তারপর দ্বিতীয় দশকে এতেকাফ করেছি। অতঃপর ঐশী আগন্তুক কর্তৃক আমাকে বলা হয়েছে, নিশ্চয় উহা শেষ দশকে। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি এতেকাফ করতে চায়, সে যেন এতেকাফ করে।[67]

অতঃপর লোকেরা তাঁর সাথে এতেকাফ করেছে। ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন, ‘এতেকাফ করা যে সুন্নাত সে সম্পর্কে আলেমদের মধ্যে কোন মতবিরোধ আমার জানা নেই।’

তাই কুরআন-সুন্নাহ্‌ ও ইজমার দলীলের ভিত্তিতে এতেকাফ করা সুন্নাত।

এতেকাফ করার স্থান হচ্ছে, যে কোন শহরে অবস্থিত মসজিদ। যেখানে জামাতে নামায অনুষ্ঠিত হয়। কেননা আল্লাহ্‌ বলেছেনঃ মসজিদ সমূহে ইতেকাফ করা অবস্থায়..।উত্তম হচ্ছে জুমআর মসজিদে এতেকাফ করা। যাতে করে জুমআ আদায় করার জন্য বের হতে না হয়। অন্য মসজিদে এতেকাফ করলেও কোন অসুবিধা নেই, তবে জুমআর জন্য আগে ভাগে মসজিদে চলে যাবে।

এতেকাফ কারীর জন্য সুন্নাত হচ্ছে, আল্লাহ্‌র আনুগত্যপূর্ণ কাজ তথা কুরআন তেলাওয়াত, যিকির, নফল নামায প্রভৃতিতে মাশগুল থাকা। কেননা এতেকাফের উদ্দেশ্যই হচ্ছে এটা। মানুষের সামান্য কথাবার্তায় কোন অসুবিধা নেই বিশেষ করে কথা যদি উপকারী হয়।

এতেকাফকারীর জন্য স্ত্রী সহবাস ও স্ত্রী সোহাগ বা শৃঙ্গার প্রভৃতি হারাম।

মসজিদ থেকে বের হওয়া তিন ভাগে বিভক্তঃ

1)       জায়েয। শরীয়ত অনুমদিত ও অভ্যাসগত যরূরী কাজে বের হওয়া। যেমন জুমআর নামাযের জন্য বের হওয়া, পানাহার নিয়ে আসার কেউ না থাকলে সে উদ্দেশ্যে বের হওয়া। ওযু, ফরয গোসল, পেশাব-পায়খানার জন্য বের হওয়া।

2)       ওয়াজিব নয় এমন নেকীর কাজে বের হওয়া। যেমন, রোগী দেখতে যাওয়া, জানাযায় শরীক হওয়া। তবে এতেকাফ শুরু করার সময় এসমস্ত কাজের জন্য বের হওয়ার যদি শর্ত করে নেয়, তবে জায়েয হবে। অন্যথায় নয়।

3)      এতেকাফের বিরোধী কাজে বের হওয়া। যেমন বাড়ী যাওয়া বা কেনা-বেচার জন্য বের হওয়া। স্ত্রী সহবাস করা। এ সমস্ত কাজ কোনভাবেই এতেকাফকারীর জন্য জায়েয নয়।

 

 

রমজানের গুরুত্ব ও ফজিলত

প্রাচীন যুগ থেকে নিয়ে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সকল নবীদের শরীয়তে রোযার বিধান ছিল। আল্লাহ তা’আলা বলেন-

“ইয়া আইয়ুহাল্লাজিনা আমানু, কুতিবা আলাইকুমুচ্ছিয়ামু কামা কুতিবা আলাল্লাজিনা মিন্‌ কব্‌লিকুম লাআল্লাকুম তাত্তাকুন”

অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, এর মাধ্যমে হয়ত তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে। (সূরা বাকারা -১৮৩)

রমজান মাস সিয়াম সাধনা ও তাকওয়ার মাস, কল্যাণ ও বরকতের মাস, রহমত ও মাগফিরাত এবং জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তি লাভের মাস। মহান আল্লাহ এ মাসটিকে বহু ফজিলত ও মর্যাদা দিয়ে অভিষিক্ত করেছেন। এ গুরুত্ববহ তাৎপর্যময় মাস সারা বিশ্বের মুসলমানদের সুদীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যায়। এ কারণেই বলা হয়, পবিত্র রমজান মাস হচ্ছে ইবাদত, পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত, জিকর, শোকর ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক বিশেষ মৌসুম। একদা নবী করিম (সা) মাহে রমজানের প্রাক্কালে বলেন, “রমজান মাস আগতপ্রায়, এ মাস বড়ই বরকতের মাস, আল্লাহ তাআলা বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করেন এবং খাস রহমত বর্ষণ করেন, গুনাহ মাফ করেন ও দোয়া কবুল করেন।” রোজাদারের মর্যাদা উল্লেখ করে হাদিস শরিফে রাসূল (সা) এরশাদ করেছেন, “রোজাদারের নিদ্রা ইবাদতের সমতুল্য, তার চুপ থাকা তসবিহ পাঠের সমতুল্য, সে সামান্য ইবাদতে অন্য সময় অপেক্ষা অধিকতর সওয়াবের অধিকারী হয়। ঈমান ও এহতেসাবের সঙ্গে যে ব্যক্তি রোজা রাখে তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।” আর রোজাদারের মর্যাদা সম্পর্কে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, “মানুষ যত প্রকার নেক কাজ করে আমি তার সওয়াব ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ বৃদ্ধি করে দিই। কিন্তু রোজা এই নিয়মের বাইরে। রোজার সওয়াব একই নিয়মে সীমাবদ্ধ বা সীমিত নয়। রোজার সওয়াবের পুরস্কার স্বয়ং আমি প্রদান করব। অথবা আমি নিজেই রোজার সওয়াবের পুরস্কার।” এ প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে উল্লেখ হয়েছে, যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো নফল কাজ করল সে যেন অন্য মাসে একটি ফরজই আদায় করল। আর যে এ মাসে কোনো ফরজ আদায় করল সে যেন অন্য মাসে ৭০টি ফরজ আদায় করল। নবী করিম (সা) ঘোষণা করেছেন, “যারা রমজান মাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রোজা পালন করেছে, তারা ওই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে, যেদিন তাদের মাতা তাদের নিষ্পাপরূপে প্রসব করেছিলেন।”

রমজান হলো কুরআন নাজিলের মাস, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন: “রমজান মাস, এতে নাজিল হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের দিশারি এবং স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী।” (সূরা বাকারা : ১৮৫) রমজান মাসে সপ্তম আকাশের লওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশে বায়তুল ইজ্জতে পবিত্র আল-কুরআন একবারে নাজিল হয়েছে। সেখান হতে আবার রমজান মাসে অল্প অল্প করে নবী করিম সা.-এর প্রতি নাজিল হতে শুরু করে। এ মাসে মানুষের হেদায়াত ও আলোকবর্তিকা যেমন নাজিল হয়েছে তেমনি আল্লাহর রহমত হিসেবে এসেছে সিয়াম। তাই এ দুই নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে বেশি বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। প্রতি বছর রমজান মাসে জিব্রাইল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (সা)-কে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন এবং রাসূল সা.-ও তাকে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন। আর জীবনের শেষ রমজানে আল্লাহর রাসূল দুই বার পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করেছেন। সহি মুসলিমের হাদিস দ্বারা এটা প্রমাণিত।

এ মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয়, জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : “রমজান মাস এলে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয় জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮০০)

এ মাসে রয়েছে লাইলাতুল ক্বদেরর ন্যায় বরকতময় রজনী : মহান আল্লাহ বলেন, “লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাত্রে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হন প্রত্যেক কাজে, তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিময় এ রজনী, ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত।’’ (সূরা আল ক্বদর : ৩-৫)

এ মাস দোয়া কবুলের মাস : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “(রমজানের) প্রতি দিন ও রাতে (জাহান্নাম থেকে) আল্লাহর কাছে বহু বান্দা মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাদের প্রত্যেক বান্দার দোয়া কবুল হয়ে থাকে (যা সে রমজান মাসে করে থাকে)।’’ (সহীহ সনদে ইমাম আহমদ কর্তৃক বর্ণিত, হাদিস নং ৭৪৫০)

রোজার পুরস্কার আল্লাহ স্বয়ং নিজে প্রদান করবেন : একটি হাদিসে কুদসিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ বলেন, “বনি আদমের সকল আমল তার জন্য, অবশ্য রোজার কথা আলাদা, কেননা রোজা আমার জন্য এবং আমিই এর পুরস্কার দেবো।’’ (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮০৫)

রোজা রাখা গোনাহের কাফফারা স্বরূপ এবং ক্ষমালাভের কারণ : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রামাদান মাসে রোজা রাখবে, তার পূর্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’’ (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৯১০)

রোজা জান্নাত লাভের পথ : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে যাকে বলা হয় ‘রাইয়ান’। কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে রোজাদারগণ প্রবেশ করবে। অন্য কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না….. রোজাদারগণ প্রবেশ করলে এ দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আর কেউ সেখান দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’’ (সহীহ বুখারি, হাদিস নং ১৭৯৭)

সিয়াম রোজাদারের জন্য কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন: “কিয়ামতের দিন রোজা এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, ‘হে রব! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও প্রবৃত্তির কামনাল হতে বাধা দিয়েছি; সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন।’ কুরআন বলবে, ‘আমি তাকে রাতের বেলায় ঘুমাতে দেইনি; সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। ফলে এ দুয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’ ’’ (মুসনাদ, হাদিস নং ৬৬২৬)

রোজা জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তিলাভের ঢাল : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন : যে বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোজা রাখে আল্লাহ তার মাঝে এবং জাহান্নামের মাঝে ৭০ বছরের দূরত্ব তৈরি করেন। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮৯৪)

এ মাসের রোজা রাখা একাধারে বছরের দশ মাস রোজা রাখার সমান : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “রমজানের রোজা দশ মাসের রোজার সমতুল্য, ছয় রোজা দুই মাসের রোজার সমান, এ যেন সারা বছরের রোজা।”

রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের সুগন্ধির চেয়েও উত্তম : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ তার শপথ! রোজাদারের মুখের গন্ধ কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে মিসকের চেয়েও সুগন্ধিময়।’’ (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮৯৪)

রোজা ইহ-পরকালে সুখ-শান্তি লাভের উপায় : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “রোজাদারের জন্য দুটো খুশির সময় রয়েছে। একটি হলো ইফতারের সময় এবং অন্যটি স্বীয় প্রভু আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার সময়।’’ (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮০৫)

রমযান মাসের আরো ফজিলতের মধ্যে রয়েছে
এক.
রোজাদারকে ইফতার করানো : সহীহ সনদে তিরমিযী ও আহমাদ বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করায়, সে উক্ত রোজাদারের সাওয়াবের কোনরূপ ঘাটিত না করেই তার সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে।’’ (সুনান তিরমিযী, হাদিস নং ৮০৭)
দুই. এ মাস সবর বা সহিষ্ণুতার মাস : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত এ হাদীসে রামাদান মাসকে সবরের মাস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন : “সবরের মাসে রোজা রাখা ও প্রত্যেক মাসে তিন দিন রোজা রাখা অন্তরের অস্থিরতা দূর করে থাকে।” (আল বানী বলেন হাসান-সহীহ হাদিস নং ১৭০৩৩)
তিন. কুরআন তেলাওয়াত করা এবং এর মর্ম উপলব্ধি করা
রমজান মাস কুরআন নাজিলের মাস। এ মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরাইলের সাথে কুরআন পাঠ করতেন। তার সিরাত অনুসরণ করে প্রত্যেক মু’মিনের উচিত এ মাসে বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা, বোঝা এবং আমল করা। ইবনু আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “জিবরাইল রামাদানের প্রতি রাতে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাকে নিয়ে কুরআন পাঠ করতেন।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৩০৪৮)
চার. আল্লাহর রাস্তায় বেশি বেশি দান ও সদকা করা
আল্লাহর রাস্তায় দান-সদকা ও ব্যয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। সব সময় যাতে সামর্থ্যবান ব্যক্তিবর্গ এ ইবাদাত পালন করে সে ব্যাপারে ইসলাম ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করেছে। আর রমজান মাসে এ ইবাদাতের তাৎপর্য ও গুরুত্ব আরো বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। কেননা ইমাম বুখারী ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেন যে, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল মানুষের চেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন। আর রমজান মাসে যখন জিবরাইল তার সাথে সাক্ষাতে মিলিত হতেন তখন তিনি আরো দানশীল হয়ে উঠতেন…। জিবরাইলের সাক্ষাতে তিনি বেগবান বায়ুর চেয়েও বেশি দানশীল হয়ে উঠতেন।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৩০৪৮)
পাঁচ. বেশি বেশি দোয়া, জিকর এবং ইস্তেগফার করা
রমজানের দিনগুলোতে পুরো সময়টাই ফজিলতময়। তাই সকলের উচিত এ বরকতময় সময়ের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা- দোয়া, যিকর ও ইসস্তেগফারের মাধ্যমে। কেননা রমজান মাস দোআ কবুল হওয়ার খুবই উপযোগী সময়, যেমন প্রবন্ধের শুরুতে একটি হাদিসের বর্ণনায় বলা হয়েছে।
ছয়. সকল প্রকার ইবাদতে নিজেকে ব্যাপৃত রাখা :
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাদান মাসে অন্য মাসের চেয়েও বেশি বেশি ইবাদাত করতেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়েম (রহ) বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ ছিল রমজান মাসে সকল ধরনের ইবাদাত বেশি বেশি করা। তিনি ছিলেন সবচেয়ে দানশীল এবং রামাদানে আরো বেশি দানশীল হয়ে যেতেন,  কেননা এ সময়ে তিনি সদকা, ইহসান ও কুরআন তেলাওয়াত, নামাজ, যিকর ও ইতেকাফ ইত্যাদি সকল প্রকার ইবাদত অধিক পরিমাণে করতেন। তিনি রামাদানে এমন বিশেষ ইবাদাতসমূহ পালন করতেন যা অন্য মাসগুলোতে করতেন না। (যাদুল মাআ‘দ ১/৩২১)
সাত. কিয়ামু রমজান বা রমজানের তারাবিহের ফজিলত
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে রমজানের তারাবিহ আদায় করল তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য এক হাদিসে এভাবে ইরশাদ করেছেন, “যখন কোন ব্যক্তি ইমামের সাথে ইমাম তার নামাজ শেষ করা পর্যন্ত নামাজ আদায় করবে তার জন্য তা সারা রাত জেগে ইবাদত করা হিসেবে গণ্য হবে।”
আট. লাইলাতুল ক্বাদরের বিশেষ ফজিলত
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “আমরা লাইলাতুল কাদরে তা (কুরআন) নাজিল করেছি, আপনি কি জানেন লাইলাতুল কাদর কী? লাইলাতুল ক্বাদর হাজার মাসের চেয়ে উত্তম, এতে ফিরেশতাকুল ও জিবরাইল তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে সকল বিষয় নিয়ে অবতীর্ণ হয়, ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত ইহা শান্তিময়।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে লাইলাতুল কাদর জেগে ইবাদত করল তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।”

নয়. রমযান মাসে ইতিকাফের গুরুত্ব অপরিসীম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : যে ব্যক্তি কোনো একদিন ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদে অতিবাহিত করে জাহান্নাম তার থেকে আসমান-জমীনের দূরত্বের তিন গুণ দূরে সরে যায়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন : যে ব্যক্তি এক দিনও ইতিকাফে বসবে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার মধ্যে এবং জাহান্নামের মধ্যে তিন খন্দকের ব্যবধান করবেন। এক খন্দক পাঁচশত বছরের পথ।

হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইবাদত-বন্দেগীর কাজে এতই কষ্ট স্বীকার করতেন যা অন্য সময় করতেন না। (তিরমিজী)

শরীয়তের পক্ষ থেকে মূলত ছোট-বড় সকল গোনাহ ও পাপ সর্বদা বর্জন করার নির্দেশ এসেছে। আর রমজান মাস  ফজিলতের মাস এবং আল্লাহর ইবাদাতের প্রশিক্ষণ লাভের মাস হওয়ায় এ মাসে সর্বপ্রকার গোনাহের কাজ পরিত্যাগ করা অধিক বাঞ্ছনীয়। তদুপরি রামাদান মাসে সৎকাজের সওয়াব ও নেকি বহুগুণে বৃদ্ধি পায়, তাই রমজানের সম্মান ও ফজিলতের কারণে এ মাসে সংঘটিত যে কোন পাপের শাস্তি অন্য সময়ের তুলনায় ভয়াবহ হবে এটাই স্বাভাবিক। এ জন্যই রোজাদারদের উচিত তাকওয়াবিরোধী সকল প্রকার মিথ্যা কথা ও কাজ পরিপূর্ণভাবে বর্জন করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি (রোজা রেখে) মিথ্যা কথা ও সে অনুযায়ী কাজ করা বর্জন করে না তবে তার শুধু খাদ্য ও পানীয় বর্জন করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮০৪)
অন্য আরেকটি হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমাদের কেউ রোজার দিনে অশ্লীল কথা যেন না বলে এবং শোরগোল ও চেঁচামেচি না করে। কেউ তাকে গালমন্দ করলে বা তার সাথে ঝগড়া করলে শুধু বলবে, আমি রোজাদার।’’ (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮০৫)
যে ব্যক্তি কল্যাণকামী মাস মাহে রমজান পেয়ে নিজের গুনাহ মাফ করতে পারলো না, সে হল সবচেয়ে হতভাগ্য ব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে হাদিস : হযরত কাব কর্তৃক হাদিসটি বর্ণিত। একদা রাসূল (সা) মসজিদে ইরশাদ করলেন : “তোমরা মিম্বরের নিকটবর্তী হও। আমরা নিকটে গেলাম। হুজুর (সা) মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রেখে বললেন, ‘আমীন’। এভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সিঁড়িতে পা রেখেও দুইবার আমীন বললেন। খুতবা শেষে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে হযরত বললেন, এই মাত্র হযরত জিবরাঈল (আ) তাশরিফ এনেছিলেন। প্রথম সিঁড়িতে পা রাখতেই তিনি বললেন, ঐ ব্যক্তির ওপর লানত যে রমজান মাস পেয়েও নিজের পাপ মাফ করিয়ে নিতে পারেনি। আমি বললাম, ‘আমীন’ অর্থাৎ তাই হোক। দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখতেই জিবরাঈল বললেন, লা’নত ঐ ব্যক্তির ওপর যার সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হওয়া সত্ত্বেও দরূদ পড়েনি। আমি বললাম, ‘আমীন’। অতপর তৃতীয় সিঁড়িতে আমি পা রাখতেই জিবরাঈল বললেন, লা’নত ঐ ব্যক্তির ওপর যার সামনে মাতা-পিতা উভয়ই অথবা দু’জনের একজন বার্ধক্যে পৌঁছেছে কিন্তু সে তাদের সেবাকর্মে নিজেকে জান্নাতের যোগ্য করতে পারলো না। উত্তরে আমি বললাম, ‘আমীন’।

ত্বাকওয়া অর্জনের এ মুবারক মাসে মুমিনদের উপর অর্পিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, সৃষ্টি হয়েছে পূণ্য  অর্জনের বিশাল সুযোগ এবং প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে মহান চরিত্র অর্জনের সুন্দর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। এ অর্পিত দায়িত্ব পালন এবং সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আজ সারা বিশ্বের মুসলিমদের উচিত চারিত্রিক অধঃপতন থেকে নিজেদের রক্ষা করা, নেতিয়ে পড়া চেতনাকে জাগ্রত করা এবং সকল প্রকার অনাহুত শক্তির বলয় থেকে মুক্ত হয়ে হক প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞাকে সুদৃঢ় করা, যাতে তারা রিসালাতের পবিত্র দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে এবং কুরআন নাযিলের এ মাসে কুরআনের মর্ম অনুধাবন করতে পারে, তা থেকে হিদায়াত লাভ করতে পারে এবং জীবেনের সর্বক্ষেত্রে একেই অনুসরণের একমাত্র মত ও পথ রূপে গ্রহণ করতে পারে। মাহে রমজানে রোজার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মানুষের কুপ্রবৃত্তিকে দমন করেন। রিপুর তাড়না থেকে তাকে মুক্ত করে তার ভেতর তাকওয়া-খোদাভীতি ও আল্লাহপ্রেম জাগ্রত করতে চান। সেই সত্য-সুন্দরের পথ তাকে সাফল্য ও মুক্তির দ্বারপ্রান্তেনিয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে রমজান মাসের রোজা, পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত, সেহির, ইফতার, তারাবি নামাজ, সাদাকাতুল ফিতর, জাকাত, দান-খয়রাত প্রভৃতি আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতরাজি, যা রোজাদারদের কুপ্রবৃত্তি দমন ও তাকওয়া বা খোদাভীতিপূর্ণ ইবাদতের মানসিকতা সৃষ্টিতে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জোগায়। পবিত্র মাহে রমযানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সর্বজনীন-কল্যাণের শাশ্বত চেতনায় সকল অকল্যাণ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মানবতাকে বিজয়ী করার পথে আমাদের এগিয়ে দিক। আল্লাহ আমাদের সকল আমল কবুল করুন এবং আমাদের সবাইকে আরো উত্তম আমল করার তাওফীক দান করুন।

লায়লাতুল কদরের গুরুত্ব

‘‘ইন্না আনযালনাহু ফি লাইলাতুল কাদরে। ওয়ামা আদরাকা মা লাইলাতুল কাদরে। লায়লাতুল কাদরে, খায়রুম মিন আলফে সাহরিন। তানাযযালুল-মালায়িকাতো ওয়াররুহো ফিহা বিইযনি রাবিবহিম মিন কুল্লি আমরিন। সালামুন হিয়া হাত্তা মাতলায়িল ফাজরি।’’ (সুরা কাদর ১-৫ আয়াত) ইরশাদ হচ্ছে- ১। আমি ইহা অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে; ২। আর মহিমান্বিত রজনী সম্বন্ধে তুমি কি জান? ৩। মহিমান্বিত রজনী সহস্র মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। ৪। সে রাতে ফিরিশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাহাদিগকে প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। ৫। শান্তিই শান্তি, সেই রজনী উষার আবির্ভাব পর্যন্ত।

রমজানুল মোবারকের রাত্রি সমূহের মধ্যে একটি রাত্রিকে ‘‘শবে কদর’’ বলা হয়। উহা বড়ই মঙ্গল ও বরকতের কল্যাণময় রাত। কালামে পাকে উক্ত রাতকে এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম বলা হয়েছে। এক হাজার মাসে ৮৩ বছর ৪ মাস হয়। ভাগ্যবান ঐসব লোক যাদের উক্ত রাত্রির ইবাদত বন্দেগী নসীব হয়। কেননা এই একটি মাত্র রাত যে ইবাদতে কাটালো সে যেন ৮৩ বছর ৪ মাসের চেয়ে বেশি সময় ইবাদতে কাটালো। (সুবহানাল্লাহ) আর এই বেশির অবস্থাও জানা নাই যে উহা হাজার মাস অপেক্ষা কত মাস অধিক উত্তম। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বনিয়ন্তা আল্লাহ পাকের সেরা অবদান শবে-কদর। আল্লাহ পাক সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে নিজেই বলেছেন যে, পবিত্র রমযান মাসে কুরআন মজীদকে অবতীর্ণ করা হয়েছে যে তিনি কদরের রাত্রিতে কুরআন পাক নাযিল করেছেন। নবী করিম (সাঃ) বনী ইসরাইলের সামউনের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, তিনি এক হাজার মাস পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতেন, দিনের বেলা রোজা রাখতেন এবং সারারাত ইবাদতে কাটাতেন। এর প্রতি সাহাবাগণের মনে ঈর্ষা ও হতাশার ভাব দেখা দিলে আল্লাহতায়ালা উহার ক্ষতিপূরণস্বরূপ কেবলমাত্র উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য সেরা অবদান শবে কদর দান করে সুরা কদর নাযিল করেন। হযরত আইয়ুব (আঃ), হযরত যাকারিয়া (আঃ) প্রত্যেকেই ৮০ বছর পর্যন্ত আল্লাহপাকের ইবাদতে অতিবাহিত করেন, মুহূর্তের জন্যও আল্লাহর নাফরমানী করেননি। কাজেই শবে কদরের একটি বিশেষ রাতে যে ইবাদত বন্দেগীতে কাটালো সে যেন মহা সৌভাগ্যবান এবং উক্ত রাতে যে ব্যক্তি আল্লাহর করুনা ও কল্যাণ হতে বঞ্চিত থাকে সে সর্বহারা ও চিরবঞ্চিত। উক্ত রাতে ফেরেস্তা এবং রূহ আল্লাহর রহমত ও করুণা নিয়ে জমিনে অবতরণ করেন। উক্ত রাতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেবল শান্তি আর শান্তি এবং উক্ত রাতে বরকত ও কল্যাণ ভোর পর্যন্ত থাকে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে বলা হয় যে ব্যক্তি মহিমান্বিত শবে কদরে ঈমান সহকারে ও সওয়াবের নিয়্যতে ইবাদত করার জন্য দন্ডায়মান হয় তার বিগত জীবনের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) হতে বর্ণিত হাদীসে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন যে, রমযানের শেষ দশ দিনের যে কোন বিজোড় রাত্রিতে শবে কদর তালাশ কর। বোখারী শরিফের অপর হাদীসে পাওয়া যায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীগণকে শবে কদরের সুনির্দিষ্ট সংবাদ দেয়ার জন্য বাইরে আসেন। কিন্তু সেই সময় দু’জন মুসলমানের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছিল বলে উহার নির্দিষ্টতা আল্লাহর তরফ থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, অর্থাৎ ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। হাদীসের বিশেষ শিক্ষণীয় এই যে দু’জন মুসলমানের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ কঠিন অপরাধ। উহার জন্য কল্যাণ ও বরকত উঠিয়ে নেয়া হয়, পারস্পরিক সুসম্পর্ক সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, আর পরস্পর কলহ বিবাদ দ্বীনকে ধ্বংস করে। শবে কদরের শিক্ষা ও মহিমা অপার। এই রাতেই লাওহে মাহফুজ হতে প্রথম আকাশে কোরআন মজীদ নাযিল করা হয়। মানুষের কল্যাণের জন্য রুহুল কুদ্দুস বা হযরত জীবরাঈল (আঃ) ও অসংখ্য ফেরেস্তা সহ আল্লাহর নির্দেশে পৃথিবীতে আগমণ করেন, উক্ত রাতে আধ্যাত্মিক, জৈবিক উন্নতি ও কল্যাণ বৃদ্ধির এক বর্ষা মুখর রাতে বৃষ্টির ধারার মত বর্ষণ হতে থাকে। এই রাত শান্তি ও সান্তনার রাত, নিরাপত্তার রাত।
বিখ্যাত তফসীরে কাদেরীতে উল্লেখ আছে, ইমাম শাফী (রাঃ) রমযানের ২১ ও ২৩ রাত্রিতে শবে কদর উদযাপনে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেন, অধিকাংশ আলেমগণ এবং হানাফী মাযহাবে ২৭শে রাত্রিতে শবে কদর উদযাপনের উপর বেশি গুরুত্ব দেন। কারণ স্বরূপ ব্যাখ্যা করা হয় যে, আরবী লাইলাতুল কদরে নয়টি অক্ষর রয়েছে এবং সুরা কদরে লাইলাতুল কদর কথাটি তিনবার নির্ধারিত হয়েছে। কাজেই (৯x৩)=২৭ অক্ষর ইশারা করা হয়েছে যে, রমজান মাসের ২৭শে রাত্রিতেই শবে কদর পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং মুসলিম বিশ্বে রমযান মাসের ২৭শে রাত্রিতে শবে কদর রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন করা হয়ে থাকে। রমযান মাসে যারা জামাতের সাথে নিয়মিত তারাবীর নামাজ, এশার নামাজ ও ফজরের নামাজ আদায় করেন তারা শবে কদরের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হন না।

রমযান মাসের শেষ দশকে যারা সুন্নতে মোয়াক্কাদা কেফায়া হিসাবে মসজিদে এতেকাফ পালন করেন তারা অবশ্যই শবে কদরের রাত পেয়ে থাকেন। সব রকম পাপাচার ত্যাগ করে মানব মনের পশু প্রবৃত্তিকে ও ষড় রিপুকে দমন করে পূর্বের পাপরাশির স্মরণে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে এই মহান রজনীতে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর নিকট পাপের ক্ষমা ভিক্ষা করতঃ আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে উক্ত রাত অতিবাহিত করা ঈমানদার বান্দাগণের মহান কর্তব্য। শবে কদরের মহান রাতের সদ্ব্যবহার করা প্রত্যেক ঈমানদার মানুষের একান্ত কর্তব্য এবং এতেই বিশ্বশান্তি ও মানব কল্যাণ নিহিত। আল্লাহ আমাদিগকে শবে কদর রাতের সদ্ব্যবহার করার তৌফিক দিন। (আমিন)

লায়লাতুল কদরের ফজিলত ও তাৎপর্য

লাইলাতুল কদরকে উর্দূ ও ফার্সিতে সবে কদর বলে। সব অর্থ রাত। কদর অর্থ সম্মান। সুতরাং সবে কদর অর্থ সম্মানিত রাত। আবার কদরের অন্য অর্থ হচ্ছে তাকদির। এ শব্দটি ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। অতএব, শবে কদরের অনেক গুরুত্ব ও বৈশিষ্ঠ্য রয়েছে। এ রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে স্বয়ং আল্লাহ পাক পূর্ণাঙ্গ ‘‘সূরা কদর’’ নাযিল করেছেন। এই সূরায় আল্লাহ পাক বলেন, ‘‘ নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাযিল করেছি মহিমান্বিই রাতে। সবে কদর সম্পর্কে আপনি জানেন কি? শবে কদর হলো হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেস্তারাও রুহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালন কর্তার নিদের্শক্রমে। এটা নিরাপত্তা যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে’’।
শবে কদরের ইতি কথাঃ- একদিন রাসূল (সঃ) বনি ইসরাইলের চারজন অবেদের কথা বলেন, যারা ৮০ বছর পর্যন্ত নিরলস ভাবে আল্লাহ পাকের ইবাদতে রত ছিলেন। ঐ সময়ে এক মুহুর্তের জন্যও আল্লাহ পাকের হুকুমের বরখেলাপ করেননি। উক্ত চার জন অবেদ হলেন, হযরত আয়ুব (আঃ), হযরত জাকরিয়া (আঃ), হযরত হিজকিল (আঃ) এবং হযরত ইউশাবিন  নুন (আঃ)। রসূল (সঃ) এ কথা শুণে সাহাবায়েকেরাম খুবই আশর্যান্বিত ও বিচলিত হলেন যে তাদের পক্ষে এতা ইবাদত করা সম্ভব নয়। কারণ আখেরী নবী উম্মত ৬০-৭০ বছরের মধ্যে ইন্তেকাল করেন। কাজেই তাদের সমান বয়স না পাওয়ায় এতো ইবাদত করা সম্ভব নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ পাক ‘‘সূরা কদর’’ নাযিল করে সাহাবায়েকেরাম শান্তনার বাণী শুনিয়ে ছিলেন। আল্লাহ পাক বলেন, শবে কদরের ইবাদত ১ হাজার মাসে ইবাদতের চেয়েও বেশি বরকতময় ও শ্রেষ্ঠ। এ রাতেই প্রথম কোরআন নাযিল হয়। এ রাতে হযরত জিব্রাইল (আঃ) অগনিত ফেরেস্তারা নিয়ে ধরা পৃষ্ঠে অবতরণ করে বিস্ববাসীর জন্য অসংখ্য কল্যাণ ও প্রাচুর্য বিতরণ করেন। এ রাতে আল্লাহর মাহবুব বান্দরা অবর্নণীয় আন্তরিক শান্তি অনুভব করেন। এ রাতে অবিরাম ধারায় আল্লাহ তা’য়ালার রহমত ও বকরত বিশ্ববাসী ও মুমিনদের অন্তরে নেমে আসে। আল্লাহ পাক অসংখ্য পাপীকে ক্ষমা করে থাকেন। এ রাতে তওবা কবুল হয়। আসমানের সমস্ত দ্বার খুলে দেওয়া হয়। এ রাতে গরম ও শীত কোনোটি বেশি অনুভূত হয় না। ফজর পর্যন্ত নক্ষত্র অটুট থাকে। সূর্য উদয় কালে প্রখরতা থাকেনা ও সূর্য উদয় কালে শয়তান উপস্থিত থাকে না। এতএব পবিত্র রমজান মাসে শেষ ১০ দিনে বেজোড় রাত গুলোতে শবে কদরকে অনুসন্ধান করতে হয়। অর্থাৎ ২১, ২৩, ২৫, ২৭, ও ২৯ তারিখ রাত সমূহে শবে কদর ঘটে থাকে। রসূল (সঃ) বলেছেন তুমি যদি চাও তোমাদের কবর নূরের দ্বারা উজ্জ্বল হোক, তাহলে শবে কদরের রাত্রে ইবাদত কর। যে ব্যক্তি শবে কদরের রাতকে জিন্দা রাখে কেয়ামতের দিন তার দিল মুরদা হবে না। বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি শবে কদরকে জিন্দা রাখে, সে ১০০ বছর ইবাদত করার সওয়াব পাবে। তবে ২৭ রমজান শবে কদর ঘটার পক্ষে অনেকে মত প্রকাশ করেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে, ৭ সংখ্যার মধ্যে বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে: যথা (১) আল্লাহ পাক আসমান বানিয়েছেন ৭টি (২) জমিনও ৭ পরণ (৩) সাফা ও মারওয়াতে সায়ী করতে হয় ৭ বার (৪) কা’বার তাওয়াব করতে হয় ৭ বার   (৫) শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ করতে হয় ৭বার  (৬) মানবকে সৃষ্টি করেছেন ৭ পর্যায়ে।
(এক) মৃত্তিকার সারংশ  (দুই) শক্রু(তিন) জমাট রক্ত (চার) মাংস পিন্ড(পাঁচ) অস্থি পিঞ্জির
(ছয়) অস্তিকের মাংস দ্বারা আবৃতকরণ (সাত) রুহ সংযুক্তকরণ (আট) কোরআনের কেরাত ৭ প্রকার (নয়) নামাজের সেজদাহ ৭ অঙ্গ দ্বারা করা হয়। (দশ) দোযখের সংখ্যা ৭টি   (এগার) কোরআনের আল্লাহ পাক ৭ বার কসম খেয়েছেন। কোরআন শরীফে ৯৭নং ‘‘সূরা কদর’’ এ কদর শব্দটি তিনবার বলা হয়েছে। এ সূরায় লায়লাতুল কদর লিখতে ৯টি অক্ষর লাগে। এ ৯ সংখ্যাটিকে উক্ত ৩ দ্বারা গুন করলে ২৭ সংখ্যাটি দাঁড়ায়। উক্ত ৯৭ ও ২৭ সংখ্যা ২ এর মধ্যেও ৭ সংখ্যাটি সংযোগ হয়ে সাতের গুরুত্ব বহন করেছে। অন্যান্য বড় বড় পবিত্র রাতের তারিখ নির্ধারিত রয়েছে। কিন্ত শবে কদরের তারিখ নির্ধারিত নেই। তাই রমজানের শেষ ১০দিন বেজোড় রাত সমূহের মধ্যে লায়লাতুল কদর তালাশ করতে হয়। আমাদের কথা হলো ৭নিয়ে, তাই বলছি, ২০ এর সংঙ্গে ৭ যোগ করলে ২৭ হয় এই জন্য আমাদের ধারণা শবে কদর ও রমজানের ২৭ রাতে ঘটে থাকে।হযরত উবাইদ বিন ওমর (রাঃ) বলেছেন, আমি ২৭ রমজান শবে কদরের সুর সাগরে জাহাজে চড়লাম। যকন সাগরের পানির স্বাদ গ্রহণ করি, তখন দেখি, পানি খুবই মিষ্টি। আর জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। আর দেখলাম সমস্ত বৃক্ষ সেজদায় পড়ে আছে। শবে কদর যখন ঘটবে, তখন কিছু আলামত উপলদ্ধি করা যায়। লাখ লাখ ফেরেস্তা যারা নাজিল হয়েছেন তারা সব ইবাদতকারীর সঙ্গে মোসাফাহা করেন। তখন অন্তরে খুশ অনুভ’ত হয়। শরীরের লোম খাড়া হয়। চোখ দিয়ে অশ্রু বের হয়। তখন দোয়া ও কবুল হয়। তবে হযরত ইবনে মাসউদ বলেছেন, যে ব্যক্তি সারা বছর জাগ্রত থেকে রাতে ইবাদত করে, সে অবশ্যই শবে কদর লাভ করবে। তাই ওলামায়েকেরামদের অভিমত হলো, রমজানের শেষ ১০ দিন ই’তেকাফ পালন করে যেন শবে কদর তালাশ করা হয়। হযরত আবুহুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেন, যদি তোমরা কবরকে আলোকময় পেতে চাও তাহলে লাইলাতুল কদর জাগ্রত থেকে ইবাদত কর। (মিশকাত ও বাইহাকি) রাসুল (সাঃ) আরো ইরশাদ করেন তোমরা লাইলাতুল কদরকে মাহে রামজানের শেষ দশকের বেজোড় রাত সমুহে তালাশ কর, (বুখারি শরিফ)। হযরত উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন,রমজানের ২৭ তারিখের রাত্রের ভোর পর্যন্ত ইবাদত বন্দেগী আমার কাছে সারা রামজানের অন্য সব রাত্রের ইবাদত অপেক্ষা অধিক প্রিয়, (তিরমিযি)।
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর পেল কিন্তু ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে কাটাতে পারলনা তার মত হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নেই। রাসুল (সাঃ) আরো ইরশাদ করেন, যেলোক শবে কদর থেকে বঞ্চিত হয়, সে যেন সমগ্র কল্যাণ থেকে পরিপুর্ণ বঞ্চিত হল, (ইবনে মাজাহ)। হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা আমি রাসুল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আমি যদি কদরের রাত সর্ম্পকে অবহিত হতে পারি, তবে আমি কি করব ? তখন রাসুল (সাঃ) আমাকে বললেন,তোমি একটি দোয়া পাঠ কর। সেই দোয়াটি হল, আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি। তাই সারা রাত জাগরণ থেকে সঠিক ভাবে ইবাদত বন্দেগীতে মনোনিবেশ করা সকলের জন্য একান্ত কর্তব্য। বেশী বেশী নফল নামাজ, তাহাজ্জুদ, সালাতুস তাসবীহ, উমরী কাযা নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, দান-সাদকা, যিকির-অযকার, তাসবীহ-তাহলীল, তাওবা-ইসতেগফার, দোয়া দরুদসহ ইত্যাদি নফল আমলের প্রতি মনোযুগি হওয়া একান্ত জরুরী। আল্লাহ যেন আমাদের সকলকে বিদআ’ত ও কুসংস্কার মুক্ত বিশুদ্ধ ইবাদত ও আমল করার তাওফীক দান করুন, আমিন!!